মাসুদ আজহারকে কেন ভয় পায় ভারত

অনলাইন ডেস্ক: পাকিস্তান এবং পাকিস্তান শাসিত কাশ্মিরের যে নয়টি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে বলে ভারত জানিয়েছে, তার মধ্যে একটি বাহাওয়ালপুর। বাহাওয়ালপুরে ‘নিশানা‘ করা হয়েছিল ‘সুবহান আল্লাহ‘ মসজিদকে, যাকে শসস্ত্র সংগঠন জয়শ-ই-মোহাম্মদের কেন্দ্র হিসেবে দাবি করেছে ভারত।

ওই কেন্দ্রকে ‘উগ্রবাদী ঘাঁটি‘ বলে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সেখানে ‘সংগঠনটির সদস্যদের নিয়োগ, সামরিক ও আদর্শগত প্রশিক্ষণ‘ দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে।

এদিকে, এসব দাবি নাকচ করে দিয়ে পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ করেছে, বেসামরিক নাগরিকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছে ভারত।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বিবিসি উর্দুকে জানিয়েছেন, বাহাওয়ালপুরের কাছে আহমদপুর শারকিয়ার সুবহান আল্লাহ মসজিদে হামলায় ১৩ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিন বছরের দুই শিশুকন্যা, সাতজন নারী ও চারজন পুরুষ রয়েছেন। ঘটনায় আহত হয়েছে নয়জন নারী ও ২৮ পুরুষসহ ৩৭ জন।

বিবিসি সিন্দির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের তরফে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জয়শ-ই-মোহম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ সদস্য ও চার ঘনিষ্ঠ সহযোগী নিহত হয়েছে বলে বুধবার একটি বিবৃতি দিয়েছে সংগঠনটি (জইশ-ই-মোহম্মদ)।

নিহতদের মধ্যে মাসুদ আজহারের বড় বোন ও ভগ্নিপতি, ভাইপোর স্ত্রী ও ভাইঝি এবং পাঁচজন শিশু রয়েছেন।

জয়শ-ই-মোহাম্মদের বিবৃতি অনুযায়ী, সুবহান আল্লাহ মসজিদে মাসুদ আজহারের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠদের মৃত্যু হয়েছে।

‘অপারেশন সিঁদুর‘-এর পর আবার আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে মাসুদ আজহার, যার নাম ২০২৪ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড‘ ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে ভারতের সংসদে হামলা, পুলওয়ামা হামলাসহ একাধিক ঘটনায় জড়িত থাকার কথিত অভিযোগ রয়েছে।

কে এই মাসুদ আজহার?

মাসুদ আজহারের জন্ম ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে বসবাসকারী আল্লাহ বখশ সাবির পরিবারে। তার বাবা বাহাওয়ালপুরের একটি সরকারি স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন।

করাচীর জামিয়াতুল উলুম ইসলামিয়া থেকে স্নাতক পাস করার পরে মাসুদ আজহার জামিয়া বানুরিয়ায় শিক্ষক হিসবে নিযুক্ত হন। তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচিত মাওলানা তাহির ‘রিসাল-ই-জাহদ‘ পত্রিকায় লিখেছেন, ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় মাসুদ আজহার কয়েকজন সঙ্গীদের সাথে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন।

মাওলানা তাহিরের কথায়, আফগানিস্তানে ৪০ দিনের ‘জিহাদের প্রশিক্ষণ‘ শেষ করেন এবং ‘স্থায়ীভাবে জিহাদের পথে‘ থাকার শপথ নেন মাসুদ আজহার।

তদন্তের সময় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে দেয়া এক বিবৃতিতে অবশ্য মাসুদ আজহার দাবি করেন, হরকত-উল-মুজাহিদিনে যোগ দেয়ার পর তাকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছিল।

কিন্তু চেহারা দুর্বল হওয়ায় কারণে তিনি ৪০ দিনের বাধ্যতামূলক ‘জিহাদ প্রশিক্ষণ‘ শেষ করতে পারেননি।

সাংবাদিকতার বিষয়ে ঝোঁক

আফগানিস্তান থেকে ফেরার পর মাসুদ আজহার করাচী ছাড়াও হায়দরাবাদ, সুক্কুর, খাপ্রো, নবাবশাহ এবং অন্যান্য অঞ্চলে ‘জিহাদের‘ প্রচার করেন। তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ এবং ‘জিহাদ প্রচারের‘ জন্য সাংবাদিকতাও শুরু করেছিলেন।

১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে তিনি ‘সাদে মুজাহিদ‘ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকা শসস্ত্র সংগঠন হরকত-উল-মুজাহিদিনের সমর্থিত বলে জানা যায়।

মাসুদ আজহার জিহাদ-ই-ইসলামি, ইতিহাস এবং ‘জিহাদি প্রশিক্ষণ‘ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন। তিনি ‘আফগানিস্তানে জিহাদের গুরুত্ব‘ সম্পর্কেও বই লিখেছেন।

কথিত অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ

ভারতে মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। এই তালিকায় রয়েছে ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর শ্রীনগরের বিধানসভা চত্বরে হামলা। এই ঘটনায় ৩৮ জনের মৃত্যু হয়।

দিল্লির সংসদে ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর সশস্ত্র হামলায় ছয় নিরাপত্তারক্ষী এবং অন্য তিন ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এই হামলার পেছনেও তিনি ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু হয়েছিল। জয়শ-ই মোহাম্মদ পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছিল।

কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের সময় ‘মুক্তি‘

কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের সময় সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল মাসুদ আজহারের নাম। ১৯৯৯ সালে কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের সময় সশস্ত্র গোষ্ঠীর যে তিনজনের মুক্তির দাবি জানানো হয়েছিল, তার মধ্যে মাসুদ আজহার ছিলেন অন্যতম।

ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে মাসুদ আজহারকে খুঁজছিল।

ভারতে সশস্ত্র সংগঠন জয়শ-ই-মোহম্মদের নেতা মাসুদ আজহার। তাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বারবার জন্য পাকিস্তানকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, জয়শ-ই-মোহম্মদের সদর দফতর পাকিস্তানের পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরে অবস্থিত।

কিন্তু পাকিস্তান বরাবরই দাবি করে এসেছে, তিনি পাকিস্তানে নেই। এই পরিস্থিতিতে, ‘অপারেশন সিঁদুর‘-এ প্রথমবার সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে ভারতের হামলা চালানোর পিছনে এটি একটি বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের সূচনা

ভারত ২০০৯ সাল থেকে মাসুদ আজহারের সংগঠন জয়শ-ই-মোহাম্মদকে জাতিসঙ্ঘের উগ্রবাদী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে। চীন এর বিরুদ্ধে বারবার ভেটো দিয়েছে।

তবে প্রায় ১০ বছরের প্রচেষ্টার পর পুলওয়ামা হামলার পরে ২০১৯ সালের পহেলা মে জাতিসঙ্ঘ মাসুদ আজহারের সংগঠনকে ‘উগ্রবাদী সংগঠন‘ হিসেবে ঘোষণা করে। পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের নিষেধাজ্ঞা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে মাসুদ আজহারের নেতৃত্বে জয়শ-ই-মোহাম্মদ ‘উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য বিপুল নিয়োগ অভিযান চালিয়েছে এবং যুবকদের ভারতের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করছে।‘

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে মাওলানা মাসুদ আজহারকে নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, করাচীতে পড়াশোনাকালীন ‘জিহাদি কার্যকলাপের সাথে মাসুদ আজহারের যোগসূত্র তৈরি হয়।‘

ভারতে গ্রেফতার

বিবিসি উর্দুতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মাসুদ আজহার ‘বিশ্বব্যাপী জিহাদে‘ বিশ্বাসী। এর জন্য তিনি ভারত, বাংলাদেশ, সৌদি আরব এবং জাম্বিয়া, পাশাপাশি যুক্তরাজ্য সফর করেছিলেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ওই প্রতিবেদনে অনুযায়ী, তিনি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেনি। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে দিল্লি এসেছিলেন বিমানে করে।

সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনে (সিবিআই) দেয়া বিবৃতিতে মাসুদ আজহার বলেছিলেন যে ‘জিহাদ সম্পর্কিত বাস্তবতা খতিয়ে দেখার জন্য তাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল।‘ এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে পর্তুগিজ পাসপোর্টে দিল্লি পৌঁছান।

দিল্লির একটি নামকরা হোটেলে থাকার পর তিনি প্রথমে দেওবন্দ এবং পরে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে পৌঁছান, যেখান থেকে ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তাকে নিজেদের হেফাজতে নেয়।

গ্রেফতার করার ১০ মাসের মধ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা দিল্লিতে কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে অপহরণ করে এবং তাদের মুক্তির বিনিময়ে মাসুদ আজহারের মুক্তির দাবি জানায়।

উত্তর প্রদেশ এবং দিল্লি পুলিশ সাহারানপুর থেকে বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম হওয়ায় তাদের ওই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।

এর এক বছর পর হরকাত-উল-আনসার গোষ্ঠী আবার কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে অপহরণ করে আজহার মাসুদকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর কাঠমান্ডু থেকে দিল্লিগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান অপহরণ করে কান্দাহারে অবতরণ করানো হয়।

ছিনতাইকারীরা বিমানে থাকা ১৫৫ জন যাত্রীর মুক্তির বিনিময়ে মাসুদ আজহারের মুক্তি দাবি করে এবং দীর্ঘ আলোচনার পরে মাসুদ আজহার এবং আরো দুই সঙ্গীকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এর আগ পর্যন্ত তিনি জম্মুর কোট ভালওয়াল কারাগারে বন্দি ছিলেন। জানা গেছে, সেই সময় ওই কারাগারে কাশ্মির থেকে গ্রেফতার হওয়া কাশ্মিরি, আফগান ও পাকিস্তানি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা বড় সংখ্যায় বন্দি ছিলেন।

এই তালিকায় শ্রীনগরের হরকত-উল-মুজাহিদিনের কমান্ডার বলে পরিচিত সাইফুল্লাহ খান ও তার দুই ভাইও ছিলেন।

শ্রীনগরে বিবিসির সাবেক সংবাদদাতা জুবায়ের আহমেদের সাথে কথোপকথনের সময় সাইফুল্লাহ খান দাবি করেন, জেলে থাকাকালীন মাসুদ আজহার কয়েকটি বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘মাওলানার কাজ একটাই- বক্তৃতা দেয়া। তিনি বন্দুক তুলে নেননি, কাউকে হত্যা করেননি। তিনি জিহাদের আদর্শ নিয়ে বক্তৃতা দিতেন।‘

সাইফুল্লাহর খানের মতে, আজহার মাসুদের বক্তব্য কারাগারে উপস্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের উপর ‘ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।‘

বিবিসি নিউজ উর্দুর বর্তমান সম্পাদক আসিফ ফারুকি বিবিসি হিন্দিকে বলেন, ‘পাকিস্তানে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জয়শ-ই-মোহাম্মদের কিছু কার্যকলাপ লক্ষ্য করা গেছে।‘

আসিফ ফারুকি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে কান্দাহারের ঘটনার পর মাসুদ আজহার আফগানিস্তানে তালিবানের সহায়তায় জয়শ-ই-মোহম্মদ গঠন করে। দুই-তিন বছর পর তাকে পাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয় এবং তার সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।‘

প্রসঙ্গত, মাসুদ আজহারকে জনসমক্ষে খুব কমই দেখা গিয়েছে। হাফিজ সইদের মতো পাকিস্তানের গণমাধ্যমে প্রকাশিত শিরোনামে তাকে দেখা যায় না।

গত দুই দশকে মাসুদ আজহারের জনসমক্ষে উপস্থিতির বিষয়ে মাত্র দু‘বার আলোচনা হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে ফারুকি বলেন, ‘তাকে করাচীর একটি সমাবেশে দেখা গিয়েছিল এবং তারপরে তাকে মুজাফফরাবাদের পরে জিহাদি তানজিমদের একটি সম্মেলনে দেখা গিয়েছিল।‘

সূত্র : বিবিসি

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title