অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে না করার আহ্বান তারেক রহমানের
- আপডেট সময় : ১২:৫৪:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
- / 7
নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের সঙ্গীদের ‘অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে না করার’ আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপি জুলাই সনদের অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘কেউ যদি অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল ভেবে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায় বা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অপকৌশল অবলম্বন করে, তা শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
বুধবার (১২ নভেম্বর) রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তারেক রহমান এসব কথা বলেন।
দেশ এবং জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জনসমর্থিত দল হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রাখার ব্যাপারে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘এটা কথার কথা নয়, এটি প্রমাণিত সত্য।
রাজনৈতিক ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি অধিকাংশ পয়েন্টেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। অতএব আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার, জুলাই সনদে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি এসব অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে কোনো রাজনৈতিক দল যদি অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল পেয়ে যা ইচ্ছা তা-ই আদায় করে নিতে চায় কিংবা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি না সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের সঙ্গীদের প্রতি আহ্বান, অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে করবেন না।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে তারেক রহমান বলেন, ‘কর্মঘণ্টার টাকা কে দেবে? নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে চাকরিদাতাদের কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে কি না, দেশের নারীসমাজের মধ্যে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়ছে, আমার মনে হয় এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবী নারীদের মনে ছড়িয়ে পড়া চাকরি সংকোচনের আতঙ্ক কাটানো এই মুহূর্তে কথিত গণভোটের চেয়ে বেশি দরকার।’
দেশে বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সম্প্রতি একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৮ শতাংশ। আরো ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
দেশে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। দেশে উচ্চ মাধ্যমিক এবং গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী প্রতি পাঁচজনের একজন বেকার। সম্প্রতি বিজিএমইএ জানিয়েছে, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে কমপক্ষে ৩৫৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এক লাখ ২০ হাজার মতো শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কর্মহীন এইসব মানুষগুলোর কাছে রাষ্ট্রের হাজার টাকা ব্যয় করে কথিত গণভোটের চাইতে একটি চাকরি কি বেশি জরুরি নয়?
এই সরকার মাসের পর মাস রাষ্ট্র মেরামতের নানা উপাদান নিয়ে আলোচনা করলেও রাষ্ট্রের লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনার জন্য একটি দফাও উত্থাপন করেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
এত সংস্কার কমিটি হলো অথচ একটি শিক্ষা সংস্কার কমিটি করা হলো না। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়ের একটি দিক সম্পর্কে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’
সাম্প্রতিক প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের কথা উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘২০২৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ছিল সর্বনিম্ন। অন্যদিকে পরীক্ষায় দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে পাস করতে পারেনি। ইংরেজির পর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী তথ্য-প্রযুক্তি, অর্থাৎ আইসিটিতে অকৃতকার্য হয়েছে। ইংরেজি এবং আইসিটির মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ে এভাবে অকৃতকার্য হতে থাকলে বর্তমানে এআই যুগের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকা সম্ভব কি না, এই প্রশ্নটিও রাখলাম। তবে আমি মনে করি, বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজে শিক্ষাদীক্ষায় টিকে থাকতে হলে আমাদের তথাকথিত গণভোট নিয়ে গবেষণার পরিবর্তে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে গবেষণা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’
পলাতক লুটেরা বাহিনীর বেপরোয়া লুটপাটের পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের কমপক্ষে ২৪টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। জনগণকে ভয় দেখাতে চাই না…তবে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নাজুক হয়ে উঠছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ নয়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর আর কোনো সরকারের পক্ষেই সেই রেকর্ড অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশেরও কম।
রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স, এই মুহূর্তে এই দুটি খাতই দেশের অর্থনীতির প্রধান ভরসার খাত মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, ‘গত কয়েক মাসে রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ এবং বিদেশে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরাও বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি স্থিতিশীল সরকার। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা শর্ত দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ একদিকে নির্বাচন না করেই রাষ্ট্রযন্ত্রে খবরদারির সুযোগ গ্রহণ করা, অন্যদিকে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম করা। পলাতক স্বৈরাচারের সহযোগীরা গত কয়েক দিন খোদ রাজধানীতে যেভাবে আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটি একটি সতর্কবার্তা হতে পারে বলে আমি মনে করি।’
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একটি দল ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে ফ্যাসিবাদীদের ছাতার নিচে আশ্রয় নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচার একইভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলটির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে কি না, এ ব্যাপারে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।’
গণভোটের আড়ালে পতিত পরাজিত পলাতক অপশক্তিকে রাষ্ট্র রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কি না প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই। স্বল্প মেয়াদের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ সব ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা আশা করে না। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্বও নয়।’
অন্তর্বর্তী সরকার দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি একটি রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করবে, নাকি দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আয়োজনকেই অগ্রাধিকার দেবে।’
রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, “কথাটি আমি এর আগেও একবার বলেছিলাম, উত্তর কোরিয়ার সংবিধানে লেখা রয়েছে ‘ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া’। সংবিধানে লেখা থাকলেই সব কিছু নিশ্চিত হয়ে যায় না। আসলে সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র রাজনীতি সম্পর্কে মোনাফেকি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতার, প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মানসিকতার, সর্বোপরি প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য।”






















