রোমানিয়ার শ্রম ঘাটতি পূরণে অবদান রাখছেন বিদেশি কর্মীরা। কিন্তু অতি ডানপন্থি বক্তব্য, অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানো আর পথে-ঘাটে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায়, যাদের ওপর দেশটির শ্রমবাজার নির্ভর করছে, সেই শ্রমিকেরা এখন দেশটিকে ভয় পাচ্ছেন।
একসময় পশ্চিম ইউরোপের শ্রমবাজারের ঘাটতি পূরণে কর্মী পাঠানোর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল রোমানিয়া। কিন্তু এখন দেশটি নতুন এক উদ্বেগের মুখোমুখি: সেখানে কাজ করতে আসা বিদেশি কর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ যেমন বাড়ছে, তেমনি শোষণের ঝুঁকিও বেড়ে চলেছে।
রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে কাজ করেন ২৯ বছর বয়সি বাংলাদেশি অভিবাসী সাব্বিরুল আলম৷ ফুড ডেলিভারি রাইডার হিসেবে কর্মরত এই বাংলাদেশি অন্ধকার নেমে এলে আর কাজ করার সাহস পান না।
আগস্টে এক বাংলাদেশি রাইডারের ওপর হামলার ঘটনা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে৷ ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, “আমি ভয় পাচ্ছি”। রোমানিয়ার পতাকা সম্বলিত একটি কালো ক্যাপ মাথায় দিয়ে আলম বলেন, “আমার মনে হয়, মানুষ খুব রেগে আছেন।”
আলম যে বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন, সেটা ছিল রোমানিয়া রাস্তায় এক বাংলাদেশি অভিবাসীর ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা। আক্রমণকারী চিৎকার করে বলছিল, “তোমার দেশে ফিরে যাও!” এবং “তুমি একজন আক্রমণকারী”।
চরম ডানপন্থি এইউআর দলের এক নেতা ফেসবুকে রোমানিয়ানদের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, তারা যেন বিদেশি রাইডারদের কাছ থেকে ফুড ডেলিভারি না নেন। সেই আহ্বানের দিন কয়েকপরই ওই ঘটনাটি ঘটে।
রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকুশোর ডান ওই হামলাটিকে “বিদেশি-বিদ্বেষী সহিংসতা” উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছিলেন৷ তিনি আরো বলেছিলেন, এই হামলা “বিদেশিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উসকে দেওয়া বক্তব্যের” কারণেই ঘটেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স প্ল্যাটফর্মে তিনি লিখেছিলেন, “শব্দের বাস্তবতা কখনও কখনও নাটকীয় পরিণতি ডেকে আনে।”
অপরিহার্য, তবুও অবাঞ্ছিত
রোমানিয়ানরা যখন ভালো বেতনের চাকরির আশায় বিদেশে যেতে শুরু করেন, তখন দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম বড় শ্রম সংকটের মুখোমুখি হয়।
২০২৪ সালের শেষে অন্তত এক লাখ ৪০ হাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশ থেকে আসা কর্মীরা রোমানিয়ার নির্মাণ, উৎপাদন, বাণিজ্য ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করছিলেন। এসব কর্মীদের বেশিরভাগই ছিলেন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক ও ভারতের নাগরিক। কিন্তু অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে তাদের প্রতি বিদ্বেষও।
রোমানিয়ার এমপ্লয়ার্স’ ফেডারেশন অব লেবার ফোর্স ইমপোর্টার্স-এর প্রেসিডেন্ট রোমুলুস বাদেয়া এএফপিকে বলেছেন, বিদেশি শ্রমিকদের ওপর হামলা এখনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও তিনি আশা করেন, এটি যেন “একটি প্রবণতায়” রূপ না নেয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, অনলাইনে ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং মিথ্যা দাবিও বেড়েছে, যেমন: “এই মানুষগুলো আমাদের চাকরি কেড়ে নিতে এসেছেন।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা কিছু ছবিতে দেখা গেছে কয়েকজন ডেলিভারি রাইডার তাদের খাবারের ব্যাগে লিখছেন, “আমি রোমানিয়ান”— যেন সন্দেহের পরিবেশে নীরবে আত্মরক্ষার একটি কৌশল।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈষম্যবিরোধী সংস্থা ইউরোপীয় কমিশন অ্যাগেইনস্ট রেসিজম অ্যান্ড ইনটলারেন্স (ইসিআরআই) সতর্ক করে জানিয়েছে, “উদ্বেগের বিষয় হলো রাজনৈতিক বক্তব্যে, সংবাদমাধ্যমে ও অনলাইনে ঘৃণামূলক ভাষার ব্যবহার বাড়ছে।”
চরম-ডানপন্থি দলগুলো এখন রোমানিয়ার পার্লামেন্টের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভূয়া তথ্যও দ্রুত ছড়ানো হচ্ছে। এইউআর দলের নেতা জর্জ সিমিওন সম্প্রতি দাবি করেছেন, রোমানিয়ানদের চেয়ে অভিবাসীদের ভালো বাসস্থান দেওয়া হচ্ছে৷ যদিও ভবন মালিকেরা এমন দাবি খারিজ করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, অ্যাপার্টমেন্টগুলো সব শ্রমিকদের জন্যই নির্ধারিত।
অনিয়মিত প্রবেশ কমেছে
শিরোনামের আড়ালে থাকলেও ২০২৩ সাল থেকে রোমানিয়ার সীমান্ত পরিস্থিতি ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, সার্বিয়ার সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ, ফ্রন্টেক্স-এর বাড়তি উপস্থিতি এবং আশ্রয় ও ফেরত প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে ইইউর পাইলট প্রকল্পের কারণে অনিয়মিত সীমান্ত পারাপার ও পুনঃপ্রবেশের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
২০২৪ সালে সীমান্ত কর্তৃপক্ষ অন্তত ১৮ হাজার ৩৯৬ বিদেশিকে রোমানিয়ার সীমান্তে শনাক্ত করেছে। যাদের বড় একটি অংশ ছিল ইউক্রেনীয় শরণার্থী।
এদিকে, ক্রোয়েশিয়া শেঙ্গেনে যোগ দেওয়ার পর রুট পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত সীমান্ত পাড়ির প্রচেষ্টা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক কমেছে। এছাড়া, ২০২৪ সালে কাজের ভিসার নিয়মকানুন আরো কঠোর করেছে বুখারেস্ট।
বর্তমানে বেশি সংখ্যক অভিবাসী নিয়মিত পথে কাজের জন্য রোমানিয়ায় আসছেন। তবুও তাদের অনিশ্চয়তা কমছে না, বরং শোষণের শিকার হচ্ছেন৷ ফলে, অনেকে পশ্চিম ইউরোপে চলে আসার ঝুঁকি নিচ্ছেন।
নিয়মিত থেকে অনিয়মিত হয়ে পড়ছেন বাংলাদেশিরা
অনেক পর্যবেক্ষক ও পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানিয়েছে, যারা অনিয়মিতভাবে রোমানিয়া ছাড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ নিয়মিত পথে কাজের ভিসায় রোমানিয়ায় এসেছিলেন।
কিন্তু চাকরি না পাওয়া এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার কারণে তারা পশ্চিম ইউরোপের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা শীর্ষে রয়েছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের অনেকেই হাঙ্গেরির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইনফোমাইগ্রেন্টস-এর আগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বাংলাদেশি কর্মী যারা রোমানিয়ায় নিয়োগ পেয়েছিলেন, কিন্তু নিয়মিত বেতন না পাওয়া, চুক্তিগত পরিবর্তনের মতো বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। এসব বিষয় তাদের নিয়মিত থেকে অনিয়মিত অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা বলকান রুট হয়ে পশ্চিম ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন।
রোমানিয়ায় বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শ্রমিকদের ঋণ-দাসত্ব এবং নথি বাজেয়াপ্ত করার ঘটনাগুলো তুলে ধরেছে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন৷ তারা বলছে, ফলে এসব অভিবাসী পশ্চিমে যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন।

























