ঢাকা ১২:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাইলট হওয়ার স্বপ্ন এখন হুইলচেয়ারে বন্দি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৯:৪৩:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • / 2

বাসিত খান মুসা। বয়স মাত্র সাত বছর। বছরখানেক আগেও তাকে ঘিরে ছিল মা-বাবার অফুরন্ত আনন্দ। একমাত্র ছেলের পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু সবকিছু তছনছ করে দিল পুলিশের একটি গুলি। পরিবারকে হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখা দুরন্ত ছেলেটির এখন ভরসা হুইলচেয়ার। সে এখন কথা বলতে পারে না, স্বাভাবিক খাবারও খেতে পারে না।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়, গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় পুলিশের ছোড়া গুলি লেগেছিল মুসার মাথায়। গুলিটি এক পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায় আরেক পাশ দিয়ে। মুহূর্তে সেই গুলিটি লাগে মুসার দাদির পেটে। পঞ্চাশোর্ধ্ব দাদির দুনিয়ার মায়া ছাড়তে হলেও প্রাণে বেঁচে আছে ছোট্ট মুসা।

জুলাই আন্দোলন ঘিরে রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল সোমবার (২৭ অক্টোবর)। এদিন বেলা ১১টার কিছুক্ষণ আগে হুইলচেয়ারে ভর দিয়ে মুসাকে তোলা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর এজলাসে। মুসার হুইলচেয়ারের দুই পাশে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সোয়া ১১টায় শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান।

ট্রাইব্যুনালে বাবার জবানবন্দি চলার মাঝেই হুইলচেয়ার থেকে শুতে চায় একপাশ অবশ হয়ে যাওয়া মুসা। তখন তাকে ধরাধরি করে সোফায় শোয়ানো হয়। এর মধ্যেই এনজি টিউবের মাধ্যমে তাকে তরল খাবার খাওয়াতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর ফের বসানো হয় হুইলচেয়ারে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মুসার চাহনিতে দাগ কেটেছে আইনজীবীসহ সবার মনে।

সাংবাদিকদের মুসার বাবা মোস্তাফিজ বলেন, আমার একটাই ছেলে। ইংলিশ ভার্সনে পড়াশোনা করতো। ক্লাসে প্রথম ছিল। তার খুব স্বপ্ন ছিল প্লেন চালাবে। স্বপ্ন মনে হয় না আর সত্যি হবে। একসময় শুধু প্লেন প্লেন বললেও আর ওড়াতে পারবে না। ওর স্বপ্নই ছিল— ও পাইলট হবে। এ কারণে ওকে ইংলিশ ভার্সনে পড়াচ্ছিলাম। জীবনটা আমার পুরো তছনছ করে দিলো।

তিনি বলেন, এনজি টিউব দিয়ে তাকে খাওয়ানো লাগে। কারণ মুখে কিছু খেতে পারে না। তার ডানপাশ প্যারালাইজড। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক হওয়া সম্ভব, যা হয়তো বাংলাদেশে কমই আছে। যেহেতু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা সিঙ্গাপুরে হচ্ছে। সেখানকার চিকিৎসকরা বলছেন ঠিক হবে। কিন্তু অনেক সময় লাগবে। তার মাথার একপাশে খুলি নেই। আলাদাভাবে কৃত্রিম স্কাল্প লাগানো। নড়াচড়া করতে পারে না। কিন্তু কথা বুঝতে পারে, শুধু বলতে পারে না। হাঁটাচলাও করতে পারে না।

সরকারের কাছে দাবি রেখে মোস্তাফিজ বলেন, গুলিতে আমার মা তো মারা গেছেন। ছেলেটার যেন উন্নত চিকিৎসা হয়, কোনো প্রকার অবহেলিত না হয়। এতটুকুই সরকারের কাছে দাবি। তবে, আমার মাকে হত্যা ও ছেলের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের কঠোর শাস্তি হোক। আদালতের কাছে সেটিই চেয়েছি।

ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে সেদিনের পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন মোস্তাফিজুর রহমান। আর এসব বলতে গিয়ে একাধিকবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন পলাতক তিন আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। ট্রাইব্যুনালে আজ প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার, সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, রামপুরায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুই নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন মোস্তাফিজুর রহমান। তার সন্তান বাসিত খান মুসা ও মা মায়া ইসলামের শরীরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তবে তার মা মায়া ইসলাম শহীদ হয়েছেন। আর মুসাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিঙ্গাপুরে নিয়ে দীর্ঘ কয়েক মাস চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশের সিএমএইচ-এ রাখা হয়। এখনও চিকিৎসাধীন।

তিনি বলেন, মোস্তাফিজ সরাসরি দেখেছেন কীভাবে তার ছেলের মাথায় গুলিটা লাগল। গুলির ক্ষতস্থান চেপে ধরে নিয়ে দৌড়ে তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। রামপুরায় ১৯ জুলাই এ ঘটনা ঘটে, এই বড় বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। তার মাকে দাফন করা হলো গ্রামে মির্জাপুরে। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। কারণ একদিকে তার মা, অন্যদিকে সন্তান আইসিইউতে ভর্তি। এমন পরিস্থিতিতে কী হয় একটা সন্তানের বা একজন বাবার; সে বর্ণনা আদালতে দিয়েছেন। আদালত এই গুলিবিদ্ধ সন্তানকে দেখেছেন। সন্তানের ক্ষতস্থান দেখেছেন।

তামিম বলেন, এসবের মধ্যে ফুটে উঠেছে যে ১৯ জুলাইসহ পরবর্তী কয়েকটি দিন ঢাকা শহরে আন্দোলনে পুলিশ এবং তৎকালীন সরকারের বাহিনী কীভাবে নির্বিচারে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিল। আমরা ট্রাইব্যুনালে তদন্ত শেষে যে প্রতিবেদন দিয়েছি এবং বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাসহ সারাদেশে জুলাইয়ে যে প্রতিবেদন এসেছে সেসবের সত্যতা এই সাক্ষীর মাধ্যমে উঠে এসেছে।

গত ২৩ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওই দিন প্রথমেই সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেনের জবানবন্দি নেওয়া হয়। পরে তাকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন আসামি চঞ্চল। ১৬ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি এ মামলা থেকে চার আসামিরই অব্যাহতি চান।

হাবিবুর ছাড়া পলাতক বাকি তিন আসামি হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আর ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।

গত ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা।

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি। ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির। কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়েন পুলিশ সদস্যরা। এতে তিন তলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ। একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মুসার দাদি মায়া ইসলামও শহীদ হন।

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি রাতে এএসআই চঞ্চল সরকারকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল।

নতুন প্রজন্মের অনলাইন টিভি

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পাইলট হওয়ার স্বপ্ন এখন হুইলচেয়ারে বন্দি

আপডেট সময় : ০৯:৪৩:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

বাসিত খান মুসা। বয়স মাত্র সাত বছর। বছরখানেক আগেও তাকে ঘিরে ছিল মা-বাবার অফুরন্ত আনন্দ। একমাত্র ছেলের পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু সবকিছু তছনছ করে দিল পুলিশের একটি গুলি। পরিবারকে হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখা দুরন্ত ছেলেটির এখন ভরসা হুইলচেয়ার। সে এখন কথা বলতে পারে না, স্বাভাবিক খাবারও খেতে পারে না।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়, গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় পুলিশের ছোড়া গুলি লেগেছিল মুসার মাথায়। গুলিটি এক পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায় আরেক পাশ দিয়ে। মুহূর্তে সেই গুলিটি লাগে মুসার দাদির পেটে। পঞ্চাশোর্ধ্ব দাদির দুনিয়ার মায়া ছাড়তে হলেও প্রাণে বেঁচে আছে ছোট্ট মুসা।

জুলাই আন্দোলন ঘিরে রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল সোমবার (২৭ অক্টোবর)। এদিন বেলা ১১টার কিছুক্ষণ আগে হুইলচেয়ারে ভর দিয়ে মুসাকে তোলা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর এজলাসে। মুসার হুইলচেয়ারের দুই পাশে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সোয়া ১১টায় শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান।

ট্রাইব্যুনালে বাবার জবানবন্দি চলার মাঝেই হুইলচেয়ার থেকে শুতে চায় একপাশ অবশ হয়ে যাওয়া মুসা। তখন তাকে ধরাধরি করে সোফায় শোয়ানো হয়। এর মধ্যেই এনজি টিউবের মাধ্যমে তাকে তরল খাবার খাওয়াতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর ফের বসানো হয় হুইলচেয়ারে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মুসার চাহনিতে দাগ কেটেছে আইনজীবীসহ সবার মনে।

সাংবাদিকদের মুসার বাবা মোস্তাফিজ বলেন, আমার একটাই ছেলে। ইংলিশ ভার্সনে পড়াশোনা করতো। ক্লাসে প্রথম ছিল। তার খুব স্বপ্ন ছিল প্লেন চালাবে। স্বপ্ন মনে হয় না আর সত্যি হবে। একসময় শুধু প্লেন প্লেন বললেও আর ওড়াতে পারবে না। ওর স্বপ্নই ছিল— ও পাইলট হবে। এ কারণে ওকে ইংলিশ ভার্সনে পড়াচ্ছিলাম। জীবনটা আমার পুরো তছনছ করে দিলো।

তিনি বলেন, এনজি টিউব দিয়ে তাকে খাওয়ানো লাগে। কারণ মুখে কিছু খেতে পারে না। তার ডানপাশ প্যারালাইজড। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক হওয়া সম্ভব, যা হয়তো বাংলাদেশে কমই আছে। যেহেতু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা সিঙ্গাপুরে হচ্ছে। সেখানকার চিকিৎসকরা বলছেন ঠিক হবে। কিন্তু অনেক সময় লাগবে। তার মাথার একপাশে খুলি নেই। আলাদাভাবে কৃত্রিম স্কাল্প লাগানো। নড়াচড়া করতে পারে না। কিন্তু কথা বুঝতে পারে, শুধু বলতে পারে না। হাঁটাচলাও করতে পারে না।

সরকারের কাছে দাবি রেখে মোস্তাফিজ বলেন, গুলিতে আমার মা তো মারা গেছেন। ছেলেটার যেন উন্নত চিকিৎসা হয়, কোনো প্রকার অবহেলিত না হয়। এতটুকুই সরকারের কাছে দাবি। তবে, আমার মাকে হত্যা ও ছেলের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের কঠোর শাস্তি হোক। আদালতের কাছে সেটিই চেয়েছি।

ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে সেদিনের পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন মোস্তাফিজুর রহমান। আর এসব বলতে গিয়ে একাধিকবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন পলাতক তিন আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। ট্রাইব্যুনালে আজ প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার, সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, রামপুরায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুই নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন মোস্তাফিজুর রহমান। তার সন্তান বাসিত খান মুসা ও মা মায়া ইসলামের শরীরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তবে তার মা মায়া ইসলাম শহীদ হয়েছেন। আর মুসাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিঙ্গাপুরে নিয়ে দীর্ঘ কয়েক মাস চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশের সিএমএইচ-এ রাখা হয়। এখনও চিকিৎসাধীন।

তিনি বলেন, মোস্তাফিজ সরাসরি দেখেছেন কীভাবে তার ছেলের মাথায় গুলিটা লাগল। গুলির ক্ষতস্থান চেপে ধরে নিয়ে দৌড়ে তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। রামপুরায় ১৯ জুলাই এ ঘটনা ঘটে, এই বড় বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। তার মাকে দাফন করা হলো গ্রামে মির্জাপুরে। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। কারণ একদিকে তার মা, অন্যদিকে সন্তান আইসিইউতে ভর্তি। এমন পরিস্থিতিতে কী হয় একটা সন্তানের বা একজন বাবার; সে বর্ণনা আদালতে দিয়েছেন। আদালত এই গুলিবিদ্ধ সন্তানকে দেখেছেন। সন্তানের ক্ষতস্থান দেখেছেন।

তামিম বলেন, এসবের মধ্যে ফুটে উঠেছে যে ১৯ জুলাইসহ পরবর্তী কয়েকটি দিন ঢাকা শহরে আন্দোলনে পুলিশ এবং তৎকালীন সরকারের বাহিনী কীভাবে নির্বিচারে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিল। আমরা ট্রাইব্যুনালে তদন্ত শেষে যে প্রতিবেদন দিয়েছি এবং বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাসহ সারাদেশে জুলাইয়ে যে প্রতিবেদন এসেছে সেসবের সত্যতা এই সাক্ষীর মাধ্যমে উঠে এসেছে।

গত ২৩ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওই দিন প্রথমেই সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেনের জবানবন্দি নেওয়া হয়। পরে তাকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন আসামি চঞ্চল। ১৬ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি এ মামলা থেকে চার আসামিরই অব্যাহতি চান।

হাবিবুর ছাড়া পলাতক বাকি তিন আসামি হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আর ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।

গত ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা।

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি। ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির। কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়েন পুলিশ সদস্যরা। এতে তিন তলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ। একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মুসার দাদি মায়া ইসলামও শহীদ হন।

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি রাতে এএসআই চঞ্চল সরকারকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল।