৪৭ দিনের ‘আইসিইউ যুদ্ধ’, কাজ করেনি অ্যান্টিবায়োটিক!
- আপডেট সময় : ১০:২৮:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
- / 4
২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর শ্বাসকষ্ট নিয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৮ বছর বয়সী মো. সোনা মিয়া আকন্দ। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা এই কিডনি রোগী ভর্তি হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হন। তাকে তৎক্ষণাৎ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় টানা ৪৭ দিনের আইসিইউ যুদ্ধ।
দুটি বেসরকারি এবং পরে একটি সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরের পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২৫ নভেম্বর তিনি মারা যান।
মৃত ব্যক্তির ছেলে আবদুল্লাহ আল আলামিন জানান, প্রথম দিকে তার বাবার বড় ধরনের কোনো সংক্রমণ ছিল না। কিন্তু আইসিইউতে নেওয়ার পর থেকে প্রতিটি কালচার রিপোর্টেই দেখা যায়, শরীরে এমন জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে, যার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কার্যকর নয়। তিনি বলেন, “সব রিপোর্টেই একই কথা— নো সেনসিটিভ, নো ইন্টারমিডিয়েট; এভরিথিং রেজিস্ট্যান্স (সংবেদনশীল নয়, মধ্যবর্তী নয়; সবই প্রতিরোধী)।”
আইসিইউ সংক্রমণ, দাবি পরিবারের
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন আইসিইউতে থাকা রোগীরা মাল্টি–ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (বহু-ওষুধ প্রতিরোধী) জীবাণুর মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, আইসিইউতে পাওয়া জীবাণুগুলোর মধ্যে ৪১ শতাংশই কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় দীর্ঘদিন আইসিইউতে থাকা অনেক রোগীই নতুন ও মারাত্মক সংক্রমণে আক্রান্ত হন

এমন বাস্তবতারই মুখোমুখি হয়েছেন আবদুল্লাহ আল আলামিন। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তার বাবা মো. সোনা মিয়া আকন্দ ৪৭ দিন তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর মারা যান। তার পরিবারের দাবি, আইসিইউতেই তিনি এমন সংক্রমণে আক্রান্ত হন, যার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর ছিল না। আবদুল্লাহর ভাষায়, “আমার বাবা হাসপাতালে যাওয়ার সময় সংক্রমণ নিয়ে যাননি। আইসিইউতেই সংক্রমণ হয়েছে। সেখানে এমন জীবাণু পাওয়া গেছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ওষুধই কাজ করে না।”
হাসপাতালের নিত্যদিনের চিত্র হাইজিন প্রটোকল ভঙ্গ
বাবার চিকিৎসার পুরো সময় কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন আবদুল্লাহ। তিনি দাবি করেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনেক ঘাটতি ছিল। তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা গেছে একই গ্লাভস দিয়ে নার্স একাধিক রোগী দেখছেন। আইসিইউতে রোগীর আত্মীয়রা মাস্ক বা গাউন ছাড়া প্রবেশ করেছেন। সংক্রামক রোগীদের আলাদা রাখার মতো কোনো জোনিং দেখতে পাইনি। এমনকি অনেক জায়গার পৃষ্ঠতলও নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা হয়নি।”
জাতীয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সার্ভিল্যান্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইসিইউ থেকে সংগৃহীত নমুনার ৪১ শতাংশ সন্দেহভাজন প্যান-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (পিডিআর), অর্থাৎ পরীক্ষিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করেনি। সামগ্রিকভাবে হাসপাতালের নমুনায় বহু-ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর হার ৪৬ শতাংশ, আর আইসিইউতে তা ৮৯ শতাংশে পৌঁছেছে
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসবই আইসিইউ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ। আবদুল্লাহও মনে করেন, তার বাবার মৃত্যু কোনো ‘ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য’ নয়— এটি সিস্টেমিক ব্যর্থতা। তার প্রশ্ন, “যদি আইসিইউ মানে হয় উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকি, ব্যয়, নিরাপত্তাহীনতা আর ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা; তাহলে আইসিইউর উদ্দেশ্য কী?”
তিনি মনে করেন, এখনই জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে ইনফেকশন কন্ট্রোল জোরদার করা, নিয়মিত অডিট, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ওপর নজরদারি, সংক্রমণের ঝুঁকি অনুযায়ী রোগীকে আলাদা রাখা এবং হাসপাতাল–সংক্রমণের ঘটনায় কঠোর জবাবদিহি চালু করা প্রয়োজন।
বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউয়ের খরচ প্রতিদিন ৪০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। সঙ্গে থাকে ওষুধপত্র, পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ। আবদুল্লাহ আল আলামিন আরও জানান, সপ্তাহের শেষে কেবল ওষুধের বিলই অনেক সময় ২.৫ থেকে ৪.৫ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। তার ভাষায়, “জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পরিবারগুলো মানসিক চাপের পাশাপাশি আর্থিকভাবে চরম সংকটে পড়ে।”
রেজিস্ট্যান্সের ভয়াবহ চিত্র : ৪১% জীবাণু প্যান-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট
দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে শুধু আবদুল্লাহ আল আলামিন নয়, এমন অসংখ্য পরিবারই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নামক এক অচেনা যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছেন। জাতীয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সার্ভিল্যান্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইসিইউ থেকে সংগৃহীত নমুনার ৪১ শতাংশ সন্দেহভাজন প্যান-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (পিডিআর), অর্থাৎ পরীক্ষিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করেনি। সামগ্রিকভাবে হাসপাতালের নমুনায় বহু-ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর হার ৪৬ শতাংশ, আর আইসিইউতে তা ৮৯ শতাংশে পৌঁছেছে।

এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ দ্রুতই এক বিপজ্জনক ‘পোস্ট–অ্যান্টিবায়োটিক সংকটের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে সাধারণ সংক্রমণও মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
ব্যবহারে শীর্ষে সেফট্রিয়াক্সোন, দ্রুত বাড়ছে সেফিক্সিম–অ্যামিকাসিন
সারাদেশের ১৩টি সরকারি ও আটটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৫ হাজার ৮৪৪ রোগীকে নিয়ে করা আইইডিসিআর’র কেস-ভিত্তিক সার্ভিল্যান্সে দেখা যায়, দেশের হাসপাতালগুলোতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে বছরজুড়ে শীর্ষে রয়েছে সেফট্রিয়াক্সোন। পাশাপাশি দ্রুত বাড়ছে সেফিক্সিম, অ্যামিকাসিন ও ভ্যানকমাইসিনের মতো শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রবণতা রোগের ধরন ও সংক্রমণের প্রকৃতি পরিবর্তনের পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।
ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৫— টানা তিন বছর দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে শীর্ষে রয়েছে সেফট্রিয়াক্সোন। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ছিল ৩১ শতাংশ, আর ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসায় দ্রুত কার্যকারিতার কারণে সেফট্রিয়াক্সোনের ব্যবহার বেড়েই যাচ্ছে।
গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনেম তিন বছরেই দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহারের তালিকায় থাকলেও সম্প্রতি এটির ব্যবহারে সামান্য পতন হয়েছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে যেখানে এ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ছিল ১৮ শতাংশ, ২০২৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৬ শতাংশে। গবেষকদের মতে, অপ্রয়োজনীয় মেরোপেনেম ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা এবং হাসপাতালভিত্তিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রটোকল কঠোর করার ফলে এটির হ্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের এই তিন বছরের বিশ্লেষণে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে ২০২৫ সালের তালিকায়। এ বছরে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে সেফিক্সিম, যার ব্যবহার ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। একইভাবে অ্যামিকাসিন ৪ শতাংশ ব্যবহার নিয়ে প্রথমবারের মতো শীর্ষ ১০–এ জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়া, ভ্যানকমাইসিনও ২০২৫ সালে ৩ শতাংশ ব্যবহারে তালিকায় প্রবেশ করেছে, যা হাসপাতাল–সংক্রমণ ও গ্রাম–নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বৃদ্ধির ইঙ্গিত বলে ব্যাখ্যা করেছেন গবেষকেরা।
এর বিপরীতে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকা ফ্লুক্লোক্সাসিলিন ও মেট্রোনিডাজলের ব্যবহার ২০২৫ সালে এসে কমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগের প্রকৃতি পরিবর্তন, চিকিৎসা নির্দেশিকা হালনাগাদ এবং কিছু সংক্রমণে নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি চিকিৎসকদের নির্ভরতা বৃদ্ধিই এ পরিবর্তনের মূল কারণ।
৪৮% অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আইসিইউতে, ওয়ার্ডে ৪৪%
দেশের আইসিইউ, ওয়ার্ড ও বহির্বিভাগে (ওপিডি) অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেও বড় ধরনের পার্থক্য দেখা গেছে। কোথাও সেফট্রিয়াক্সোনই সর্বাধিক ব্যবহৃত, আবার কোথাও সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হয়েছে মেট্রোনিডাজোল বা মক্সিফ্লক্সাসিন। ১৫,৮৪৪টি প্রেসক্রিপশনের এই বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, একই হাসপাতালে থেকেও বিভাগভেদে সবচেয়ে বেশি ও সবচেয়ে কম ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের তালিকা সম্পূর্ণ আলাদা। সার্ভিলেন্সের তথ্য বলছে, ৪৮ শতাংশ আইসিইউ, ৮ শতাংশ ওপিডি এবং ৪৪ শতাংশ ওয়ার্ডে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয়।
২০২৩ থেকে ২০২৫— টানা তিন বছর দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে শীর্ষে রয়েছে সেফট্রিয়াক্সোন। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ছিল ৩১ শতাংশ, আর ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসায় দ্রুত কার্যকারিতার কারণে সেফট্রিয়াক্সোনের ব্যবহার বেড়েই যাচ্ছে
আইসিইউতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সেফট্রিয়াক্সোন (৩০%) ও মেরোপেনেম (২৫%)। উভয়ই ইনজেকটেবল ও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক। এর বিপরীতে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হয়েছে সেফিউরোক্সিম + ক্ল্যাভুলোনিক অ্যাসিড (২%)। এছাড়া, মেট্রোনিডাজোল ও মক্সিফ্লক্সাসিন হাইড্রোক্লোরাইড ব্যবহারের হারও তুলনামূলক কম (৩%)। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইসিইউ রোগীর গুরুতর সংক্রমণই সেফট্রিয়াক্সোন–মেরোপেনেমের উচ্চ ব্যবহারের মূল কারণ।
এদিকে, ওয়ার্ড বিভাগে সবার ওপরে রয়েছে সেফট্রিয়াক্সোন। এটির ব্যবহার ৪১ শতাংশ, যা তিন বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর সিপ্রোফ্লক্সাসিন, আজিথ্রোমাইসিন ও মেরোপেনেম। তিনটির ব্যবহারের হারই ৯ শতাংশ। ওয়ার্ডে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হলো অ্যামিকাসিন ও লেভোফ্লক্সাসিন। দুটিরই ব্যবহার মাত্র ২ শতাংশ। এই বিভাগে দেখা যায়, সেফালোস্পোরিন শ্রেণির প্রতি সবচেয়ে বেশি নির্ভরতা।

তবে, বহির্বিভাগের (ওপিডি) চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক আজিথ্রোমাইসিন ও সেফিক্সিম। উভয়ের ব্যবহার ২৪ শতাংশ। এরপর সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ১৬ শতাংশ। ওপিডিতে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হলো মেট্রোনিডাজোল ও মক্সিফ্লক্সাসিন হাইড্রোক্লোরাইড। উভয়ের ব্যবহার ২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, ওপিডিতে রোগীরা সাধারণত তুলনামূলক হালকা সংক্রমণে আসেন। এজন্য ইনজেকটেবল শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক কম ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে বেশি ও কম ব্যবহারের এই তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেফট্রিয়াক্সোন তিন বিভাগেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর শীর্ষে। মেট্রোনিডাজোল, মক্সিফ্লক্সাসিন হাইড্রোক্লোরাইড ও সেফিউরোক্সিম–ক্ল্যাভুলোনিক অ্যাসিড বেশিরভাগ বিভাগেই সর্বনিম্ন ব্যবহারের তালিকায়। এমনকি আইসিইউতে শক্তিশালী ইনজেকটেবল ওষুধ শীর্ষে, ওয়ার্ডে সেফালোস্পোরিনের আধিপত্য এবং ওপিডিতে মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়।
বিশেষজ্ঞ মতামত : প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বন্ধের দাবি
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সকে ‘ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকারিয়া আল-আজিজ। তার অভিযোগ, মূল সমস্যা হলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি, যা রেজিস্ট্যান্সকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে যে অনেক রোগীর জ্বর পর্যন্ত সারানো যাচ্ছে না। তিনি ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে কঠোর আইন প্রয়োগ করে অবিলম্বে এমন বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানান।
তার মতে, আইসিইউর পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক। সিস্টেমেটিক ইনফেকশনে যে জীবাণুগুলো আগে সহজে সাড়া দিত, সেগুলো এখন ‘মোস্ট রেজিস্ট্যান্ট’, অর্থাৎ অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিকেই প্রতিরোধী হয়ে গেছে। নতুন জীবাণুও যোগ হয়েছে তালিকায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি সেরাটিয়া মার্সেসেন্স–এর কথা বলেন। যার কারণে অনেক রোগীর জ্বর দীর্ঘ সময়েও কমছে না। “অনেকে যত ওষুধই লিখছেন, তবুও জ্বর সারানো যাচ্ছে না— এটা বড় সতর্ক সংকেত”— মন্তব্য তার।
ডা. জাকারিয়া বলেন, রেজিস্ট্যান্সের এই বিপর্যয়ের বড় অংশ তৈরি হচ্ছে ফার্মেসিভিত্তিক অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি থেকে। “একজন রোগী এলেন, গত তিন দিনে তিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন। প্রথম দিন অ্যামোক্সিসিলিন, পরের দিন ডক্সিসাইক্লিন, তৃতীয় দিন সিপ্রোফ্লক্সাসিন। গ্রামের দিকে তো আরও ভয়াবহ অবস্থা”— যোগ করেন তিনি। “কিছু দোকানে এমনকি মেরোপেনামের মতো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইনজেকশনও প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে।” এটিকে ‘ওয়ান হেলথ’ কাঠামোর দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন ডা. জাকারিয়া।
তার ভাষায়, “যতদিন অ্যান্টিবায়োটিক মুড়িমুড়কির মতো পাওয়া যাবে, ততদিন রেজিস্ট্যান্স কমার কোনো সুযোগ নেই।” চিকিৎসকদের দায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা বায়াস (পক্ষপাত) হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক লিখি না। রোগী ভালো হবে কি না— এটাই আমাদের প্রথম চিন্তা।” তিনি স্বীকার করেন, ভুল প্রেসক্রিপশন হয়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে চিকিৎসকেরা যুক্তিযুক্তভাবে ওষুধ দেন এবং পাঁচ বা সাত দিনের বেশি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
“ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের অংশটা নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু দোকানে যে লুটোপুটি চলছে, সেটা বন্ধ না হলে কিছুই পরিবর্তন হবে না”— জোর দিয়ে বলেন তিনি। এজন্য তিনি ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে কঠোর আইন প্রয়োগের আহ্বান জানান। বিশেষ করে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও দমনমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনার দাবি জানান।
বিপর্যয় রোধে ‘ওয়ান হেলথ’ কাঠামোই মূল চাবিকাঠি
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ক্রমবর্ধমান সংকট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন হাবিব জানান, এই সমস্যার উৎস শুধু হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন নয়, এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে আছে। মানুষের চিকিৎসা, পশুপালন, খাদ্য উৎপাদন এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার পুরো কাঠামোর ভেতরে এটি বিদ্যমান।
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “মানবচিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের অসংগতি এখনও পরিলক্ষিত। অনেক আন্ডার-কোয়ালিফাইড চিকিৎসক বা ভেটেরিনারি সার্ভিস কর্মী রোগের প্রকৃতি না বুঝেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন। যেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই, সেখানেও দেওয়া হচ্ছে। আবার যেখানে প্রয়োজন, সেখানে অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অবিবেচক ব্যবহার— যেটাকে আমরা বলি জুডিশিয়াস না হওয়া; রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা না বাড়ানোর পেছনে স্পষ্ট ভূমিকা রাখছে।”

ডা. হাবিবের মতে, চিকিৎসকদের ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উন্নত ল্যাব সুবিধা অপরিহার্য। দেশে অধিকাংশ হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব দুর্বল, ফলে কোন রোগজীবাণু কোন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে কাজ করবে তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। “স্পেসিফিক অর্গানিজম চিহ্নিত না করে সঠিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আর ল্যাব দুর্বল থাকলে সিদ্ধান্তগত ভুল হবেই”— বললেন তিনি।
মানবস্বাস্থ্যের বাইরে গিয়ে তিনি তুলে ধরেন পশুপালন, মৎস্য ও পরিবেশ খাতের চিত্র। তার কথায়, “লাইভস্টক ও ফিশারিতে নানা ধরনের ওষুধ, ইনসেক্টিসাইড, পেস্টিসাইড ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় নিয়মিত। অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো ব্যবহারের উপযুক্ত নির্দেশনা বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এসব রাসায়নিক ও ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের শরীরে পরোক্ষভাবে ঢুকে রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দিতে পারে।
কার্যকারিতা হারাতে শুরু করবে অ্যান্টিবায়োটিক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেশ দ্রুত এমন এক সংকটের দিকে এগোচ্ছে যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাতে শুরু করবে। তার ভাষায়, “অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) এখন যে গতিতে বাড়ছে, তা সকল আশঙ্কাকে ছাপিয়ে গেছে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশ শিগগিরই ‘পোস্ট-অ্যান্টিবায়োটিক’ বাস্তবতায় ঢুকে পড়বে। যেখানে সাধারণ ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া ব্যাকটেরিয়া দমনের কার্যকর বিকল্প আজও নেই। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়া মানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রটি হারিয়ে ফেলা।
ডা. শাহ মনিরের মতে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রথম শর্ত হলো— শক্তিশালী জাতীয় নজরদারি। তিনি জানান, ইতোমধ্যে একটি আইটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মানবস্বাস্থ্যের পাশাপাশি পশুস্বাস্থ্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতের তথ্যও সংযুক্ত হচ্ছে। এই সমন্বিত নজরদারি ভবিষ্যতে এএমআর নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “যদি সারভিল্যান্স সিস্টেম পূর্ণ সক্ষমতায় চালু হয় এবং সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করেন, তাহলে এএমআর পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। তাই অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন থেকে ব্যবহার পর্যন্ত, পুরো প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা এখন সবচেয়ে জরুরি।”
যা বলছে আইইডিসিআর
দেশের হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত রোগীর চাপ, দুর্বল অবকাঠামো এবং অপরিকল্পিত সেবা-ব্যবস্থার কারণে আইসিইউ এখন জটিল সংকটে পড়েছে। যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় সীমিত রোগী রাখার কথা, সেখানে অনেক বেশি রোগী থাকতে বাধ্য হওয়ায় সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে— জানিয়েছে আইইডিসিআর।
সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, “হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের উল্লেখযোগ্য অংশই দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হলে একজন অসংক্রমিত রোগীও খুব দ্রুত অন্য সংক্রমণে আক্রান্ত হন। এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ ‘ওভার বার্ডেন’ অর্থাৎ যেখানে পাঁচজন থাকার কথা, সেখানে যখন ৫০ জন থাকে, সংক্রমণ বাড়বেই।”
“দেশের উচ্চ জনঘনত্বের বাস্তবতায় হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা এখন কঠিন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আগুন, সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য দুর্যোগের পর হঠাৎ বাড়তি রোগীর চাপ, যা একেবারেই ‘আনপ্ল্যান্ড’। এসব পরিস্থিতি আইসিইউতে রোগী নেওয়ার সক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে।”
তিনি প্রশ্ন রাখেন, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সার্জ ক্যাপাসিটি কতটুকু? তিনি নিজেই বলেন, “কার্যকর আইসিইউ সাপোর্ট বলতে কেবল বিছানা বা যন্ত্রপাতি বাড়ানোই নয়। প্রয়োজন আধুনিক অবকাঠামো, নির্ভরযোগ্য লজিস্টিক্স, দক্ষ চিকিৎসক–নার্স এবং সহযোগী কর্মী। এই পুরো ব্যবস্থাকে একসঙ্গে শক্তিশালী না করলে মানসম্মত আইসিইউ সেবা নিশ্চিত করা যাবে না।”
অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিনের মতে, “সংক্রমণ কমাতে হলে শুধু রোগীর সংখ্যা কমানো নয় বরং অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও সাপোর্ট সিস্টেম— সবমিলিয়ে সমন্বিত উন্নয়ন জরুরি। তা না হলে হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হয়ে পড়বে।”























