ঢাকা ১২:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কিংবদন্তি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১১:২৭:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
  • / 4
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তৃত পরিক্রমায় তিনিই সেই অনিবার্য ও অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব, যাঁকে উপেক্ষা করে ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নির্মমতা কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট-শোক—কোনো কিছুই খালেদা জিয়াকে দমিয়ে দিতে পারেনি। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব শুধু ক্ষমতার আসন নয়, তা জনগণের প্রতি অঙ্গীকার, ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সংকটের মুখে দৃঢ় থাকার সাহস ও ধৈর্য ধারণ। অথই প্রতিকূলতার মাঝেও যে শান্ত, স্থির অথচ প্রবল প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ তিনি দেখিয়েছেন, সেটিই তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় স্তম্ভে পরিণত করেছে।

আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে পাওয়া, এর পেছনে তাঁর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, ধৈর্য এবং অবিচল অবস্থানই সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই ইতিহাসের বিচারে, সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিটি স্রোতোধারায় তিনিই প্রধান কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব।স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল সংঘর্ষমুখী সাহস, কৌশলগত ধৈর্য এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির এক বিরল সমন্বয়। তাঁর প্রত্যাখ্যানেই ভেস্তে যায় ওয়ান-ইলেভেনের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা, তাঁর শক্ত অবস্থানেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় একদলীয় নির্বাচনের বৈধতা এবং তাঁর নেতৃত্বেই বিএনপি টিকে থাকে সবচেয়ে দীর্ঘ দমন-পীড়নের মধ্যেও।

রাষ্ট্রীয় শক্তির সব রকম ব্যবহার, আদালত-প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, পরিবারকে টার্গেট করা—কোনো কিছুর সামনে তিনি ভেঙে পড়েননি। এই দৃঢ়তা, আপসহীন অবস্থান এবং গণতন্ত্রকে পুনর্নির্মাণের এই অবিচল লড়াই-ই তাঁকে ‘বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব’ মর্যাদায় ভূষিত করেছে। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁদের উত্থান একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং তা একটি সময়ের দাবি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর দেশ নেমেছিল নেতৃত্বশূন্যতার গভীর সংকটে।

বিএনপির অস্তিত্বই তখন প্রশ্নের মুখে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দায়িত্ব নিলেও দলের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজন নেতা, যিনি বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে দল, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যেক ধরে রাখতে পারবেন। 

এই শূন্যতার মুহূর্তেই খালেদা জিয়া সামনে এলেন। দলীয় নেতাদের আহ্বানে তিনি শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নিলেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণ করে যখন তিনি রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করলেন, তার মাত্র তিন মাস পরই দেশ তলিয়ে গেল সামরিক অভ্যুত্থানের অন্ধকারে।

জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিল, আর তার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই প্রবল ও স্পষ্ট অবস্থান নিলেন খালেদা জিয়া।এরশাদ যখন ‘এমএলআর ৮২’ নামে সামরিক ফরমান জারি করে বিরোধিতাকে সাত বছরের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল—গণতন্ত্রের জন্য বড় লড়াই আসছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের হাজারো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের মধ্যেও খালেদা জিয়া থামেননি। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। ১ এপ্রিল প্রথম বর্ধিত সভায় বক্তৃতায় তিনি জানিয়ে দিলেন—বিএনপি শুধু টিকে থাকবে না, লড়বেও। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হলে দায়ভার আসে তাঁর কাঁধে। এ সময় থেকেই তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন। তাঁর উদ্যোগে গঠিত হয় সাত দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরল। খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলেন—এই লড়াই শুধু ছাত্রদের নয়, গণতন্ত্রের। ১৯৮৪-৮৫ সালে বারবার গৃহবন্দিত্ব, গ্রেপ্তার, মামলার পরও তিনি সব কর্মসূচি অটলভাবে চালিয়ে গেছেন। ১৯৮৬ সালে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে তিনি আপসহীন অবস্থান নিলেন এবং সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় নির্বাচনে অংশ নিলেন না। ১৯৮৭ সালে শুরু হলো ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন, যা দেশব্যাপী আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল হক বাবলুর মৃত্যু আন্দোলনকে আরো উত্তাল করে তোলে। ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধে তাঁর অবস্থান আবারও স্পষ্ট—চক্রান্তমূলক নির্বাচনের বৈধতা নেই।

১৯৯০ সালে ছাত্রনেতা জেহাদের শাহাদাতের পর ২৪টি ছাত্রসংগঠন নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। নূর হোসেনের শাহাদাতের পর আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বে এই গণ-আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ পদত্যাগ করে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তর করেন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জয়ী হন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সমর্থনে সরকার গঠন করেন। ২০ মার্চ তিনি ৩২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

পঞ্চম জাতীয় সংসদে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনী পাস হয়—একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী। একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সব কার্যক্রমকে বৈধ ঘোষণা করা হয় এবং নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পুনরায় প্রধান বিচারপতির পদে ফেরার ব্যবস্থা রাখা হয়। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ১৯৭২ সালের সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয় এবং উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত হয়।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন—চারবার পাঁচটি আসনে এবং একবার তিনটি আসনে জয়ী হয়ে বিশ্বরাজনীতিতেও এক অনন্য রেকর্ড গড়েন।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন—সততা, দেশপ্রেম, উন্নয়ন ও গণমানুষের কল্যাণ খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ও নেতৃত্বে প্রতিফলিত হয়েছে। রাজপথের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি দলের আইকন হয়ে ওঠেন। দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও উৎপাদন এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাই তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি। তিনি বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ বা জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি স্টেট সিনেট তাঁকে ‘গণতন্ত্রের যোদ্ধা’ উপাধিতে ভূষিত করে।

দলের নেতৃত্বেও তিনি গণতান্ত্রিক চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন—যোগ্যতা ও কাজের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন, কমিটি গঠন এবং যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি সবার মতামত গুরুত্বসহকারে শোনেন ও তা বাস্তবায়ন করেন। একবার সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে তিনি পিছিয়ে আসেন না, যার প্রমাণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নানা মিথ্যা মামলা, কারাবাস ও নির্যাতন সহ্য করেও আপসহীন অবস্থান। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশ ভালো থাকলে, আমি ভালো থাকি’ এবং ‘এ দেশই আমার ঠিকানা’। জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁর মতো আপসহীন আর অদ্বিতীয় নেই।

অর্থনীতিতে তাঁর বড় অবদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা, আয়করের হার ৫৫ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং শুল্ককাঠামো সহজকরণ। ব্যাবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে আমদানি শুল্ক সাত ধরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। তাঁর আমলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, মধ্যপাড়ার শ্বেতপাথর খনি, ভোলা, বঙ্গোপসাগর ও দিনাজপুরে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।

শিল্প ও কর্মসংস্থানে বিশেষ অগ্রগতি ঘটে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রথম পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং প্রায় দুই লাখ নারী এতে যুক্ত হন। তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানিবণ্টন ইস্যু উত্থাপন করেন এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মায়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে হোয়াইট হাউসে বক্তব্য দেন। তাঁর নেতৃত্বে মায়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিও বাস্তবায়িত হয়।

নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাঁর স্থান হয় ২৯তম। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ও প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দূরশিক্ষণ পদ্ধতি, নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার, নারীদের জন্য এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন, ইপসা প্রতিষ্ঠা, নকল প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক উন্নতি, কৃষি আধুনিকায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

নারীর আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধিতে সহজ শর্তে ঋণ প্রকল্প, আনসার-ভিডিপি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেন। স্বাস্থ্য খাতে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালের শয্যা বৃদ্ধি এবং ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন।

তিনি বিচার বিভাগ স্বাধীনকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাড়ান এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন করেন। পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ব্যাগ ও দুই স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করেন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালান। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ, পাহাড়ি ও উপজাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার গঠিত হয়। এই সরকার দুর্নীতি দমনের নামে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়, যেখানে বিএনপি ও জিয়া পরিবার ছিল মূল টার্গেট।

৭ মার্চ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এপ্রিল মাসে খালেদা জিয়াকে জোর করে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। এরপর তাঁকে কার্যত গৃহবন্দি করা হয় এবং তাঁর দুই ছেলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বরে খালেদা জিয়া ও কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময় মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ দেন তিনি।

কারাগারে থেকেও খালেদা জিয়া দলীয় নেতৃত্ব বজায় রাখেন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান, কিন্তু তৎকালীন সরকারের গোপন সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও কেবল গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে নেতৃত্ব দেন। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৯টি আসন পায়।

২০০৯ সালের পর মহাজোট সরকার বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানি শুরু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি গৃহবন্দি, জেল, উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হয়েছেন; ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যু ও বড় ছেলে তারেক রহমানের দীর্ঘ নির্বাসন সহ্য করেছেন।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা আন্তর্জাতিক মহল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দেয়। পরবর্তী সময়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আরো সাত বছরের সাজা হয়। অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন তাঁকে বন্দি রাখা হয় এবং বিদেশে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরদিন রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার শাস্তি মওকুফ ও মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। মুক্তির পরদিন ৭ আগস্ট বিএনপির মহাসমাবেশে তিনি অংশ নেন। দীর্ঘদিন আটক থাকা নেতাকর্মীরা মুক্তি পেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ফলে বিএনপি পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণের অগ্নিবারুদ লড়াই-সংগ্রামে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য, তিনি খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়ে রাখা এক অদম্য নেত্রী, যিনি গণমানুষের আশ্রয়স্থল ও প্রত্যাশার বাতিঘর।

নতুন প্রজন্মের অনলাইন টিভি

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কিংবদন্তি

আপডেট সময় : ১১:২৭:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তৃত পরিক্রমায় তিনিই সেই অনিবার্য ও অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব, যাঁকে উপেক্ষা করে ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নির্মমতা কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট-শোক—কোনো কিছুই খালেদা জিয়াকে দমিয়ে দিতে পারেনি। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব শুধু ক্ষমতার আসন নয়, তা জনগণের প্রতি অঙ্গীকার, ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সংকটের মুখে দৃঢ় থাকার সাহস ও ধৈর্য ধারণ। অথই প্রতিকূলতার মাঝেও যে শান্ত, স্থির অথচ প্রবল প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ তিনি দেখিয়েছেন, সেটিই তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় স্তম্ভে পরিণত করেছে।

আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে পাওয়া, এর পেছনে তাঁর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, ধৈর্য এবং অবিচল অবস্থানই সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই ইতিহাসের বিচারে, সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিটি স্রোতোধারায় তিনিই প্রধান কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব।স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল সংঘর্ষমুখী সাহস, কৌশলগত ধৈর্য এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির এক বিরল সমন্বয়। তাঁর প্রত্যাখ্যানেই ভেস্তে যায় ওয়ান-ইলেভেনের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা, তাঁর শক্ত অবস্থানেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় একদলীয় নির্বাচনের বৈধতা এবং তাঁর নেতৃত্বেই বিএনপি টিকে থাকে সবচেয়ে দীর্ঘ দমন-পীড়নের মধ্যেও।

রাষ্ট্রীয় শক্তির সব রকম ব্যবহার, আদালত-প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, পরিবারকে টার্গেট করা—কোনো কিছুর সামনে তিনি ভেঙে পড়েননি। এই দৃঢ়তা, আপসহীন অবস্থান এবং গণতন্ত্রকে পুনর্নির্মাণের এই অবিচল লড়াই-ই তাঁকে ‘বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব’ মর্যাদায় ভূষিত করেছে। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁদের উত্থান একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং তা একটি সময়ের দাবি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর দেশ নেমেছিল নেতৃত্বশূন্যতার গভীর সংকটে।

বিএনপির অস্তিত্বই তখন প্রশ্নের মুখে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দায়িত্ব নিলেও দলের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজন নেতা, যিনি বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে দল, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যেক ধরে রাখতে পারবেন। 

এই শূন্যতার মুহূর্তেই খালেদা জিয়া সামনে এলেন। দলীয় নেতাদের আহ্বানে তিনি শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নিলেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণ করে যখন তিনি রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করলেন, তার মাত্র তিন মাস পরই দেশ তলিয়ে গেল সামরিক অভ্যুত্থানের অন্ধকারে।

জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিল, আর তার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই প্রবল ও স্পষ্ট অবস্থান নিলেন খালেদা জিয়া।এরশাদ যখন ‘এমএলআর ৮২’ নামে সামরিক ফরমান জারি করে বিরোধিতাকে সাত বছরের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল—গণতন্ত্রের জন্য বড় লড়াই আসছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের হাজারো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের মধ্যেও খালেদা জিয়া থামেননি। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। ১ এপ্রিল প্রথম বর্ধিত সভায় বক্তৃতায় তিনি জানিয়ে দিলেন—বিএনপি শুধু টিকে থাকবে না, লড়বেও। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হলে দায়ভার আসে তাঁর কাঁধে। এ সময় থেকেই তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন। তাঁর উদ্যোগে গঠিত হয় সাত দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরল। খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলেন—এই লড়াই শুধু ছাত্রদের নয়, গণতন্ত্রের। ১৯৮৪-৮৫ সালে বারবার গৃহবন্দিত্ব, গ্রেপ্তার, মামলার পরও তিনি সব কর্মসূচি অটলভাবে চালিয়ে গেছেন। ১৯৮৬ সালে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে তিনি আপসহীন অবস্থান নিলেন এবং সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় নির্বাচনে অংশ নিলেন না। ১৯৮৭ সালে শুরু হলো ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন, যা দেশব্যাপী আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল হক বাবলুর মৃত্যু আন্দোলনকে আরো উত্তাল করে তোলে। ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধে তাঁর অবস্থান আবারও স্পষ্ট—চক্রান্তমূলক নির্বাচনের বৈধতা নেই।

১৯৯০ সালে ছাত্রনেতা জেহাদের শাহাদাতের পর ২৪টি ছাত্রসংগঠন নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। নূর হোসেনের শাহাদাতের পর আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বে এই গণ-আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ পদত্যাগ করে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তর করেন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জয়ী হন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সমর্থনে সরকার গঠন করেন। ২০ মার্চ তিনি ৩২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

পঞ্চম জাতীয় সংসদে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনী পাস হয়—একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী। একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সব কার্যক্রমকে বৈধ ঘোষণা করা হয় এবং নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পুনরায় প্রধান বিচারপতির পদে ফেরার ব্যবস্থা রাখা হয়। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ১৯৭২ সালের সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয় এবং উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত হয়।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন—চারবার পাঁচটি আসনে এবং একবার তিনটি আসনে জয়ী হয়ে বিশ্বরাজনীতিতেও এক অনন্য রেকর্ড গড়েন।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন—সততা, দেশপ্রেম, উন্নয়ন ও গণমানুষের কল্যাণ খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ও নেতৃত্বে প্রতিফলিত হয়েছে। রাজপথের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি দলের আইকন হয়ে ওঠেন। দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও উৎপাদন এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাই তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি। তিনি বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ বা জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি স্টেট সিনেট তাঁকে ‘গণতন্ত্রের যোদ্ধা’ উপাধিতে ভূষিত করে।

দলের নেতৃত্বেও তিনি গণতান্ত্রিক চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন—যোগ্যতা ও কাজের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন, কমিটি গঠন এবং যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি সবার মতামত গুরুত্বসহকারে শোনেন ও তা বাস্তবায়ন করেন। একবার সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে তিনি পিছিয়ে আসেন না, যার প্রমাণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নানা মিথ্যা মামলা, কারাবাস ও নির্যাতন সহ্য করেও আপসহীন অবস্থান। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশ ভালো থাকলে, আমি ভালো থাকি’ এবং ‘এ দেশই আমার ঠিকানা’। জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁর মতো আপসহীন আর অদ্বিতীয় নেই।

অর্থনীতিতে তাঁর বড় অবদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা, আয়করের হার ৫৫ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং শুল্ককাঠামো সহজকরণ। ব্যাবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে আমদানি শুল্ক সাত ধরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। তাঁর আমলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, মধ্যপাড়ার শ্বেতপাথর খনি, ভোলা, বঙ্গোপসাগর ও দিনাজপুরে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।

শিল্প ও কর্মসংস্থানে বিশেষ অগ্রগতি ঘটে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রথম পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং প্রায় দুই লাখ নারী এতে যুক্ত হন। তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানিবণ্টন ইস্যু উত্থাপন করেন এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মায়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে হোয়াইট হাউসে বক্তব্য দেন। তাঁর নেতৃত্বে মায়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিও বাস্তবায়িত হয়।

নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাঁর স্থান হয় ২৯তম। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ও প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দূরশিক্ষণ পদ্ধতি, নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার, নারীদের জন্য এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন, ইপসা প্রতিষ্ঠা, নকল প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক উন্নতি, কৃষি আধুনিকায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

নারীর আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধিতে সহজ শর্তে ঋণ প্রকল্প, আনসার-ভিডিপি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেন। স্বাস্থ্য খাতে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালের শয্যা বৃদ্ধি এবং ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন।

তিনি বিচার বিভাগ স্বাধীনকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাড়ান এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন করেন। পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ব্যাগ ও দুই স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করেন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালান। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ, পাহাড়ি ও উপজাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার গঠিত হয়। এই সরকার দুর্নীতি দমনের নামে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়, যেখানে বিএনপি ও জিয়া পরিবার ছিল মূল টার্গেট।

৭ মার্চ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এপ্রিল মাসে খালেদা জিয়াকে জোর করে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। এরপর তাঁকে কার্যত গৃহবন্দি করা হয় এবং তাঁর দুই ছেলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বরে খালেদা জিয়া ও কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময় মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ দেন তিনি।

কারাগারে থেকেও খালেদা জিয়া দলীয় নেতৃত্ব বজায় রাখেন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান, কিন্তু তৎকালীন সরকারের গোপন সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও কেবল গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে নেতৃত্ব দেন। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৯টি আসন পায়।

২০০৯ সালের পর মহাজোট সরকার বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানি শুরু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি গৃহবন্দি, জেল, উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হয়েছেন; ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যু ও বড় ছেলে তারেক রহমানের দীর্ঘ নির্বাসন সহ্য করেছেন।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা আন্তর্জাতিক মহল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দেয়। পরবর্তী সময়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আরো সাত বছরের সাজা হয়। অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন তাঁকে বন্দি রাখা হয় এবং বিদেশে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরদিন রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার শাস্তি মওকুফ ও মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। মুক্তির পরদিন ৭ আগস্ট বিএনপির মহাসমাবেশে তিনি অংশ নেন। দীর্ঘদিন আটক থাকা নেতাকর্মীরা মুক্তি পেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ফলে বিএনপি পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণের অগ্নিবারুদ লড়াই-সংগ্রামে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য, তিনি খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়ে রাখা এক অদম্য নেত্রী, যিনি গণমানুষের আশ্রয়স্থল ও প্রত্যাশার বাতিঘর।