ঢাকা ০৩:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ঢাকার বাজারে সবজির দাম চড়া, কাঁচা মরিচ ৩২০ টাকা কেজি মুন্সীগঞ্জে এনসিপির পথসভায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান ইন্টারনেট বন্ধ : তদন্তে মিলেছে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রমাণ গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় সংঘর্ষে রিকশাচালক রমজান মুন্সীর মৃত্যু গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত ৫৮ হাজার ৬৭৭ ফিলিস্তিনি নারায়ণগঞ্জে জামায়াতের বিক্ষোভ, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার প্রতিবাদ কুষ্টিয়া কুমারখালীতে জমি নিয়ে সংঘর্ষ, আহত ৩ জন নির্বাচন নিয়ে ভেতরে-ভেতরে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে : রিজভী লিটনের পারফরম্যান্স নিয়ে যা বললেন নাফিস হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ: রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার রুখবে সংগঠন

ইন্টারনেট বন্ধ : তদন্তে মিলেছে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রমাণ

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:০৯:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫ ২ বার পড়া হয়েছে

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সময় হঠাৎ থেমে যায় দেশের ডিজিটাল স্পন্দন ‘ইন্টারনেট’। প্রথম ধাপে বন্ধ হয় মোবাইল ইন্টারনেট, পরে ব্রডব্যান্ড। ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আপন জগৎ থেকে। প্রযুক্তির শক্তি যেন হঠাৎ করেই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। কে করল, কেন করল, কীভাবে হলো? এমন অসংখ্য প্রশ্নে মানুষ উদ্বিগ্ন হলেও তাৎক্ষণিকভাবে মেলেনি কোনো সদুত্তর।

সময় ঘুরে আবারও এলো ১৮ জুলাই (২০২৫ সাল)। ঘটনাবহুল দিনটির এক বছর পূর্তি আজ। এই এক বছরে অনেক কিছু বদলেছে, সরকার বদলেছে, প্রতিমন্ত্রী বদলেছেন কিন্তু বদলায়নি মানুষের মনে থাকা সেই ক্ষোভ আর প্রশ্ন। যার উত্তরও মিলেছে তদন্তে। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, সেদিনের ইন্টারনেটের অনুপস্থিতি নিছক প্রযুক্তিগত কোনো বিষয় ছিল না। উল্টো এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায়।

দীর্ঘ এক বছর পর ফিরে দেখা যাক, কেমন ছিল সেই কালরাত্রি ও তার পরের ঘটনাপ্রবাহ।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট কিছুটা ধীর হয়ে আসে। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। অজুহাত দেওয়া হয়, ঢাকার তেজগাঁও, মহাখালী ও বনানী অঞ্চলে আগুন দেওয়ার কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, তাই বন্ধ হয়েছে নেট

যেভাবে বন্ধ হয় ইন্টারনেটের দুয়ার

কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট কিছুটা ধীর হয়ে আসে। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। অজুহাত দেওয়া হয়, ঢাকার তেজগাঁও, মহাখালী ও বনানী অঞ্চলে আগুন দেওয়ার কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, তাই বন্ধ হয়েছে নেট।

গত বছরের ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট / ফাইল ছবি 

সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ওই সময় বলেন, ‘সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, বন্ধ হয়ে গেছে’। তার এই বক্তব্যই যেন রসিকতা ও বাস্তবতার দোলাচল। অথচ এর আগেই দেশের আইআইজি, আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরদের কাছে বিটিআরসি থেকে ই-মেইল ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ আসে।

কারা করল, তদন্তে যা বের হলো

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়, ‘ইন্টারনেট বন্ধ ছিল সরকারের নির্দেশে’। সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক, বিটিআরসি ও এনটিএমসি এই সিদ্ধান্তে জড়িত ছিল। তদন্তে বের হয়ে আসে, কোনো ডেটা সেন্টার পুড়ে যায়নি বা কোনো সাবমেরিন কেবলও কাটা পড়েনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জুনাইদ আহমেদ পলক গণহত্যার সব পরিকল্পনার বিষয়ে জানতেন। এসব হত্যাকাণ্ডের তথ্য যাতে পুরো বিশ্ব ও দেশের মানুষ না জানতে পারেন, সেজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

বন্ধ করা হয় ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকও

ইন্টারনেটের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ অধিকাংশ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। সাধারণ ব্যবহারকারীরা তখন ভিপিএন ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। অথচ জানা যায়, সরকারপক্ষের মন্ত্রীরা বিশেষ ব্যবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেন।

টানা পাঁচ দিনের ইন্টারনেট শাটডাউন এবং পরবর্তী ধীরগতির কারণে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কমে আসে প্রায় ৫০ শতাংশ। লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ৭১ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ২০২৪-এ এসে ঠেকে মাত্র ৩৫ মিলিয়নে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর প্রযুক্তি শাটডাউনের কারণে আস্থা হারান বিনিয়োগকারীরা

৩১ জুলাই এসব প্ল্যাটফর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হলেও তার আগেই বিটিআরসি তলব করে ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের প্রতিনিধিদের। যদিও কেউ সাড়া দেয়নি। ব্যতিক্রম ছিল টিকটক, যারা মেইলে ব্যাখ্যা দিয়েছিল এবং সময় চেয়েছিল।

স্টার্টআপ বিনিয়োগে ধস, ই-কমার্সে ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি

টানা পাঁচ দিনের ইন্টারনেট শাটডাউন এবং পরবর্তী ধীরগতির কারণে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কমে আসে প্রায় ৫০ শতাংশ। লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ৭১ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ২০২৪-এ এসে ঠেকে মাত্র ৩৫ মিলিয়নে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর প্রযুক্তি শাটডাউনের কারণে আস্থা হারান বিনিয়োগকারীরা।

ই-ক্যাব জানায়, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় / ফাইল ছবি

অন্যদিকে ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব জানায়, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় প্রথম ১০ দিনে।

এছাড়া দেশজুড়ে ইন্টারনেট শাটডাউনের জেরে বিপাকে পড়েন আইটি পেশাজীবী ও ফ্রিল্যান্সাররা। অনেকেই বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ভারতের কলকাতা, দুবাই, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ছাড়াও ভিন্ন গন্তব্য ছিল নেপাল। নেপালের ট্যুরিজম বোর্ড জানায়, জুলাই মাসেই বাংলাদেশ থেকে ৩৪৭০ পর্যটক প্রবেশ করেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন ছিলেন ফ্রিল্যান্সার।

কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ইন্টারনেটের দাম কমাতে বেশকিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। তবে, ভবিষ্যতেও যেন কোনো সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা না হয় তার ওপর নির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন তৈরি করা হচ্ছেপ্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

আইনের ছলে ইন্টারনেট বন্ধ : ৯৭ (২) ধারা বাতিলের আহ্বান

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭ (২) ধারা অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা যায়। এই ধারাকে ব্যবহার করেই একের পর এক শাটডাউন ঘটেছে। তবে, বর্তমান সরকার এই ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।

বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ৯৭ (২) ধারা বাতিল করা হবে। কালাকানুন নয়, এবার সময় এসেছে নতুন যুগে প্রবেশের।

কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব / ফাইল ছবি

তিনি আরও বলেন, কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ইন্টারনেটের দাম কমাতে বেশকিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। তবে, ভবিষ্যতেও যেন কোনো সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা না হয় তার ওপর নির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন তৈরি করা হচ্ছে।

এক বছর আগে আন্দোলন থামাতে যখন পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন প্রশ্ন উঠেছিল— প্রযুক্তির এমন নির্ভরশীলতা আর সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরতাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? সেই বাস্তবতায় এক বছর পর দেশে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, তখন সেটিকে অনেকেই দেখছেন এক নতুন সম্ভাবনার দরজা হিসেবে

বিশেষ সহকারী বলেন, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখা। এক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যাতে দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত আরও শক্তিশালী ও সুরক্ষিত হতে পারে।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, এসব উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের প্রযুক্তি খাত আরও উন্নত হবে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি সমাধান ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন করছে, যাতে তারা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ আরও সহজ ও সুরক্ষিতভাবে করতে পারে।

ইন্টারনেট অবাধ রাখতে দেশে এলো ‘স্টারলিংক’

এক বছর আগে আন্দোলন থামাতে যখন পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন প্রশ্ন উঠেছিল— প্রযুক্তির এমন নির্ভরশীলতা আর সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরতাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? সেই বাস্তবতায় এক বছর পর দেশে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, তখন সেটিকে অনেকেই দেখছেন এক নতুন সম্ভাবনার দরজা হিসেবে। ৪২ হাজার টাকার এককালীন সেটআপ কিট ও সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা মাসিক খরচে মিলবে সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস গতির আনলিমিটেড কানেকশন— তাও কোনো ফাইবার ছাড়াই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক শুধু উচ্চগতির বিকল্প নয়, বরং এটি সরকার নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোর বাইরের একটি স্বাধীন নেটওয়ার্ক। এটি ইন্টারনেট অবরোধের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি শুধু কানেক্টিভিটির দিক থেকে নয়, গণতন্ত্র ও তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে পারে। ফলে কোটা আন্দোলনের সময়কার ‘নেট-অন্ধকার’ ঠেকাতে এখন অনেকেই স্টারলিংক ভরসার নাম হিসেবে দেখছেন।

স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, অনেকেই এটিকে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে দেখছেন / ফাইল ছবি 

১৮ জুলাই ‘ফ্রি ইন্টারনেট ডে’: প্রতীকী হিসেবে ফ্রি ডেটা দেবে সরকার

এক বছর আগে যেদিন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে গোটা দেশ ডিজিটালভাবে অচল হয়ে পড়েছিল, সেই ১৮ জুলাইকে এবার ভিন্নভাবে স্মরণ করতে চায় সরকার। তাই ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষ্যে চলতি বছরের ১৮ জুলাইকে ‘ফ্রি ইন্টারনেট ডে’ ঘোষণা করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এদিন দেশের সব মোবাইল গ্রাহককে পাঁচ দিন মেয়াদি এক জিবি করে ইন্টারনেট বিনামূল্যে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। এটি একধরনের প্রতীকী সম্মান ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে— প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারের স্বীকৃতিস্বরূপ।

গ্রাহকরা নিজ নিজ মোবাইল অপারেটরের নির্ধারিত কোড ডায়াল করে এই ইন্টারনেট নিতে পারবেন। যেমন— গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক গ্রাহকরা 1211807#, রবি *41807# এবং টেলিটক 1111807# ডায়াল করলে ফ্রি ডেটা যুক্ত হবে।

বিটিআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৩ জুলাই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর ৮ জুলাই কমিশনের সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ৯ জুলাই মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশ পাঠানো হয়। একইসঙ্গে টেলিভিশনের স্ক্রলে বিষয়টি প্রচারেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন সাধারণ মানুষ সচেতন হন। বাংলালিংকসহ অন্য অপারেটররা বিষয়টি বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং নিজেদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও এটি স্মরণে বিশেষ আয়োজনের কথা ভাবছে।

১৮ জুলাইকে ডিজিটাল কালো দিবস ঘোষণার দাবি

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে— এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে এক বছর আগে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অজুহাতে তৎকালীন সরকার দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত শুধু জনগণের তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করেনি, বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রাকেও থমকে দিয়েছিল।’

তিনি বলেন, মাত্র কয়েক দিনের ইন্টারনেট শাটডাউনে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। হাজার হাজার তরুণ ফ্রিল্যান্সার ও অনলাইন পেশাজীবী কাজ হারিয়ে চরম আর্থিক সংকটে পড়েন। ‘এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের প্রভাব এখনও আমরা টের পাচ্ছি’— বলেন তিনি। তাই ১৮ জুলাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ডিজিটাল কালো দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে তারা আগামী ১৮ জুলাই, শুক্রবার রাত ৮টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতীকী প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে।

মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরও জানান, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে অর্ন্তবর্তী সরকারের ‘ঐকমত্য কমিশনে’ আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে হলে ইন্টারনেট সেবা কখনোই বন্ধ করা যাবে না। ভবিষ্যতে কোনো সরকার যেন আর এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে না পারে সেজন্য সব সচেতন নাগরিককে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ইন্টারনেট বন্ধ : তদন্তে মিলেছে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রমাণ

আপডেট সময় : ১২:০৯:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সময় হঠাৎ থেমে যায় দেশের ডিজিটাল স্পন্দন ‘ইন্টারনেট’। প্রথম ধাপে বন্ধ হয় মোবাইল ইন্টারনেট, পরে ব্রডব্যান্ড। ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আপন জগৎ থেকে। প্রযুক্তির শক্তি যেন হঠাৎ করেই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। কে করল, কেন করল, কীভাবে হলো? এমন অসংখ্য প্রশ্নে মানুষ উদ্বিগ্ন হলেও তাৎক্ষণিকভাবে মেলেনি কোনো সদুত্তর।

সময় ঘুরে আবারও এলো ১৮ জুলাই (২০২৫ সাল)। ঘটনাবহুল দিনটির এক বছর পূর্তি আজ। এই এক বছরে অনেক কিছু বদলেছে, সরকার বদলেছে, প্রতিমন্ত্রী বদলেছেন কিন্তু বদলায়নি মানুষের মনে থাকা সেই ক্ষোভ আর প্রশ্ন। যার উত্তরও মিলেছে তদন্তে। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, সেদিনের ইন্টারনেটের অনুপস্থিতি নিছক প্রযুক্তিগত কোনো বিষয় ছিল না। উল্টো এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায়।

দীর্ঘ এক বছর পর ফিরে দেখা যাক, কেমন ছিল সেই কালরাত্রি ও তার পরের ঘটনাপ্রবাহ।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট কিছুটা ধীর হয়ে আসে। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। অজুহাত দেওয়া হয়, ঢাকার তেজগাঁও, মহাখালী ও বনানী অঞ্চলে আগুন দেওয়ার কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, তাই বন্ধ হয়েছে নেট

যেভাবে বন্ধ হয় ইন্টারনেটের দুয়ার

কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট কিছুটা ধীর হয়ে আসে। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। অজুহাত দেওয়া হয়, ঢাকার তেজগাঁও, মহাখালী ও বনানী অঞ্চলে আগুন দেওয়ার কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, তাই বন্ধ হয়েছে নেট।

গত বছরের ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট / ফাইল ছবি 

সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ওই সময় বলেন, ‘সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, বন্ধ হয়ে গেছে’। তার এই বক্তব্যই যেন রসিকতা ও বাস্তবতার দোলাচল। অথচ এর আগেই দেশের আইআইজি, আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরদের কাছে বিটিআরসি থেকে ই-মেইল ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ আসে।

কারা করল, তদন্তে যা বের হলো

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়, ‘ইন্টারনেট বন্ধ ছিল সরকারের নির্দেশে’। সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক, বিটিআরসি ও এনটিএমসি এই সিদ্ধান্তে জড়িত ছিল। তদন্তে বের হয়ে আসে, কোনো ডেটা সেন্টার পুড়ে যায়নি বা কোনো সাবমেরিন কেবলও কাটা পড়েনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জুনাইদ আহমেদ পলক গণহত্যার সব পরিকল্পনার বিষয়ে জানতেন। এসব হত্যাকাণ্ডের তথ্য যাতে পুরো বিশ্ব ও দেশের মানুষ না জানতে পারেন, সেজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

বন্ধ করা হয় ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকও

ইন্টারনেটের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ অধিকাংশ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। সাধারণ ব্যবহারকারীরা তখন ভিপিএন ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। অথচ জানা যায়, সরকারপক্ষের মন্ত্রীরা বিশেষ ব্যবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেন।

টানা পাঁচ দিনের ইন্টারনেট শাটডাউন এবং পরবর্তী ধীরগতির কারণে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কমে আসে প্রায় ৫০ শতাংশ। লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ৭১ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ২০২৪-এ এসে ঠেকে মাত্র ৩৫ মিলিয়নে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর প্রযুক্তি শাটডাউনের কারণে আস্থা হারান বিনিয়োগকারীরা

৩১ জুলাই এসব প্ল্যাটফর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হলেও তার আগেই বিটিআরসি তলব করে ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের প্রতিনিধিদের। যদিও কেউ সাড়া দেয়নি। ব্যতিক্রম ছিল টিকটক, যারা মেইলে ব্যাখ্যা দিয়েছিল এবং সময় চেয়েছিল।

স্টার্টআপ বিনিয়োগে ধস, ই-কমার্সে ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি

টানা পাঁচ দিনের ইন্টারনেট শাটডাউন এবং পরবর্তী ধীরগতির কারণে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কমে আসে প্রায় ৫০ শতাংশ। লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ৭১ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ২০২৪-এ এসে ঠেকে মাত্র ৩৫ মিলিয়নে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর প্রযুক্তি শাটডাউনের কারণে আস্থা হারান বিনিয়োগকারীরা।

ই-ক্যাব জানায়, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় / ফাইল ছবি

অন্যদিকে ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব জানায়, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় প্রথম ১০ দিনে।

এছাড়া দেশজুড়ে ইন্টারনেট শাটডাউনের জেরে বিপাকে পড়েন আইটি পেশাজীবী ও ফ্রিল্যান্সাররা। অনেকেই বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ভারতের কলকাতা, দুবাই, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ছাড়াও ভিন্ন গন্তব্য ছিল নেপাল। নেপালের ট্যুরিজম বোর্ড জানায়, জুলাই মাসেই বাংলাদেশ থেকে ৩৪৭০ পর্যটক প্রবেশ করেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন ছিলেন ফ্রিল্যান্সার।

কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ইন্টারনেটের দাম কমাতে বেশকিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। তবে, ভবিষ্যতেও যেন কোনো সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা না হয় তার ওপর নির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন তৈরি করা হচ্ছেপ্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

আইনের ছলে ইন্টারনেট বন্ধ : ৯৭ (২) ধারা বাতিলের আহ্বান

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭ (২) ধারা অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা যায়। এই ধারাকে ব্যবহার করেই একের পর এক শাটডাউন ঘটেছে। তবে, বর্তমান সরকার এই ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।

বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ৯৭ (২) ধারা বাতিল করা হবে। কালাকানুন নয়, এবার সময় এসেছে নতুন যুগে প্রবেশের।

কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব / ফাইল ছবি

তিনি আরও বলেন, কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ইন্টারনেটের দাম কমাতে বেশকিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। তবে, ভবিষ্যতেও যেন কোনো সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা না হয় তার ওপর নির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন তৈরি করা হচ্ছে।

এক বছর আগে আন্দোলন থামাতে যখন পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন প্রশ্ন উঠেছিল— প্রযুক্তির এমন নির্ভরশীলতা আর সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরতাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? সেই বাস্তবতায় এক বছর পর দেশে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, তখন সেটিকে অনেকেই দেখছেন এক নতুন সম্ভাবনার দরজা হিসেবে

বিশেষ সহকারী বলেন, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখা। এক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যাতে দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত আরও শক্তিশালী ও সুরক্ষিত হতে পারে।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, এসব উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের প্রযুক্তি খাত আরও উন্নত হবে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি সমাধান ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন করছে, যাতে তারা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ আরও সহজ ও সুরক্ষিতভাবে করতে পারে।

ইন্টারনেট অবাধ রাখতে দেশে এলো ‘স্টারলিংক’

এক বছর আগে আন্দোলন থামাতে যখন পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন প্রশ্ন উঠেছিল— প্রযুক্তির এমন নির্ভরশীলতা আর সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরতাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? সেই বাস্তবতায় এক বছর পর দেশে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, তখন সেটিকে অনেকেই দেখছেন এক নতুন সম্ভাবনার দরজা হিসেবে। ৪২ হাজার টাকার এককালীন সেটআপ কিট ও সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা মাসিক খরচে মিলবে সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস গতির আনলিমিটেড কানেকশন— তাও কোনো ফাইবার ছাড়াই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক শুধু উচ্চগতির বিকল্প নয়, বরং এটি সরকার নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোর বাইরের একটি স্বাধীন নেটওয়ার্ক। এটি ইন্টারনেট অবরোধের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি শুধু কানেক্টিভিটির দিক থেকে নয়, গণতন্ত্র ও তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে পারে। ফলে কোটা আন্দোলনের সময়কার ‘নেট-অন্ধকার’ ঠেকাতে এখন অনেকেই স্টারলিংক ভরসার নাম হিসেবে দেখছেন।

স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, অনেকেই এটিকে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে দেখছেন / ফাইল ছবি 

১৮ জুলাই ‘ফ্রি ইন্টারনেট ডে’: প্রতীকী হিসেবে ফ্রি ডেটা দেবে সরকার

এক বছর আগে যেদিন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে গোটা দেশ ডিজিটালভাবে অচল হয়ে পড়েছিল, সেই ১৮ জুলাইকে এবার ভিন্নভাবে স্মরণ করতে চায় সরকার। তাই ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষ্যে চলতি বছরের ১৮ জুলাইকে ‘ফ্রি ইন্টারনেট ডে’ ঘোষণা করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এদিন দেশের সব মোবাইল গ্রাহককে পাঁচ দিন মেয়াদি এক জিবি করে ইন্টারনেট বিনামূল্যে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। এটি একধরনের প্রতীকী সম্মান ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে— প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারের স্বীকৃতিস্বরূপ।

গ্রাহকরা নিজ নিজ মোবাইল অপারেটরের নির্ধারিত কোড ডায়াল করে এই ইন্টারনেট নিতে পারবেন। যেমন— গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক গ্রাহকরা 1211807#, রবি *41807# এবং টেলিটক 1111807# ডায়াল করলে ফ্রি ডেটা যুক্ত হবে।

বিটিআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৩ জুলাই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর ৮ জুলাই কমিশনের সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ৯ জুলাই মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশ পাঠানো হয়। একইসঙ্গে টেলিভিশনের স্ক্রলে বিষয়টি প্রচারেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন সাধারণ মানুষ সচেতন হন। বাংলালিংকসহ অন্য অপারেটররা বিষয়টি বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং নিজেদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও এটি স্মরণে বিশেষ আয়োজনের কথা ভাবছে।

১৮ জুলাইকে ডিজিটাল কালো দিবস ঘোষণার দাবি

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে— এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে এক বছর আগে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অজুহাতে তৎকালীন সরকার দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত শুধু জনগণের তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করেনি, বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রাকেও থমকে দিয়েছিল।’

তিনি বলেন, মাত্র কয়েক দিনের ইন্টারনেট শাটডাউনে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। হাজার হাজার তরুণ ফ্রিল্যান্সার ও অনলাইন পেশাজীবী কাজ হারিয়ে চরম আর্থিক সংকটে পড়েন। ‘এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের প্রভাব এখনও আমরা টের পাচ্ছি’— বলেন তিনি। তাই ১৮ জুলাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ডিজিটাল কালো দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে তারা আগামী ১৮ জুলাই, শুক্রবার রাত ৮টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতীকী প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে।

মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরও জানান, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে অর্ন্তবর্তী সরকারের ‘ঐকমত্য কমিশনে’ আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে হলে ইন্টারনেট সেবা কখনোই বন্ধ করা যাবে না। ভবিষ্যতে কোনো সরকার যেন আর এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে না পারে সেজন্য সব সচেতন নাগরিককে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।’