ছাত্র-জনতাকে হত্যার জন্য ক্ষমা চাইবেন না হাসিনা
- আপডেট সময় : ১২:৩৭:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
- / 7
অনলাইন ডেস্ক: গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হলেও এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমা চাইতে রাজি নন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের নয়াদিল্লিতে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনার দেওয়া সাক্ষাৎকার বুধবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারে তিনি তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছেন এবং চলমান বিচারকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন না করে লাখো মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছে। হাসিনার অভিযোগ, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি।
তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টে মামলা চলছে, অপরাধী বানিয়ে রায় আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি অবাক বা ভীত হবেন না বলেও উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে আগামী বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া হলে দলটির লাখ লাখ সমর্থক এই নির্বাচন বয়কট করবে। হাসিনা জানান, তার দলকে বাদ দিয়ে হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যেই সরকারই হোক তাদের সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন না এবং তিনি ভারতেই অবস্থান করবেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথম তিনি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দেশের ভবিষ্যৎ ভূমিকা পালনে ফিরে আসবে, সেটা সরকারে হোক আর বিরোধী দলে হোক এবং এখানে তার পরিবারের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, এটা আসলে আমার বা আমার পরিবারের ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই যা চাই, সেখানে সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের স্বাধীন প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ছাত্র-জনতা নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটররা শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আগামী ১৩ নভেম্বর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার তারিখ জানাবে।
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে শেখ হাসিনা বলেন, আমি নিহত প্রতিটি শিশু, ভাইবোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক জানাই। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তার দাবি, সরকার উৎখাতের জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অস্থিরতা তৈরি করে চক্রান্ত করেছিল। ব্যাপক প্রাণহানির জন্য তিনি মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়াকে দায়ী করে বলেন, একজন নেতা হিসাবে আমি চূড়ান্তভাবে নেতৃত্বের দায় নিচ্ছি, কিন্তু আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে ভিড়ের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম বা চেয়েছিলাম, এই দাবিটি পুরোপুরি ভুল।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাইয়ের একটি ফোন রেকর্ডিং প্রকাশ হয়, যেখানে হাসিনা তার ভাতিজা, ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসকে বলেন, ‘আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি এখন। এখন লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানেই পাবে সোজা গুলি করবে। এটা বলা আছে।’ তবে এএফপির কাছে হাসিনা দাবি করেছেন, অডিওটির কথাগুলো ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, আমি নিজে বাহিনীগুলোকে আন্দোলনে গুলি চালাতে বলেছি, এটা মিথ্যা।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ‘চেইন অব কমান্ডের ভেতরে কিছু ভুল অবশ্যই হয়েছিল।’
শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ‘অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার’ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। তিনি বলেন, এটা জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, যা একটি বিপজ্জনক নজির হতে যাচ্ছে।
রয়টার্সকে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অন্যায় নয়, এটি আত্মঘাতীও। উল্লেখ্য, হাসিনা সরকার ২০২৪ সালে পতনের মাত্র কয়েকদিন আগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল।
হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগসহ প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইলে, আপনি লাখ লাখ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না। উল্লেখ্য, বিগত আমলে বিরোধী দলগুলো ছাড়াই নির্বাচন করেছিল শেখ হাসিনা সরকার, যেগুলোতে লাখ লাখ ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
এএফপির কাছে হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মামলাগুলো কোনো প্রমাণসাপেক্ষে করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা গঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি রয়টার্সকে বলেন, পরবর্তী সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা থাকা আবশ্যক। দেশের লাখ লাখ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ভোট দেবে না। সমর্থকদের অন্য দলেও ভোট দিতে বলেননি শেখ হাসিনা। তার আশা, নির্বাচনের আগে তার দল কার্যক্রম চালাতে পারবে।
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে হাসিনা বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ। ভারতের বাইরে কোথাও আশ্রয় নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই বলেও জানান তিনি। হাসিনা বলেন, তিনি দিল্লিতে নিরিবিলি ও স্বাধীনভাবে বসবাস করছেন। মাঝে মাঝে শহরের লোধি গার্ডেনে হাঁটতে যান। তবে অতীতে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনার কারণে তিনি সতর্ক আছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসা জরুরি। দেশের ভবিষ্যৎ কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবার নির্ধারণ করে দিতে পারে না।
এএফপিকে হাসিনা বলেন, তার এখন অগ্রাধিকার বাংলাদেশের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, সেটা দিতে হলে ইউনূসকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পুনর্বহাল করতে হবে। রয়টার্সকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অন্যায্যই নয়, বরং আত্মঘাতী।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনি বৈধতা থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ সমর্থক, এমন পরিস্থিতি থাকলে, ভোটে অংশ নেবে না। একটি কার্যকর রাজনৈতিক সিস্টেম চাইলে আপনি লাখ লাখ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।
রয়টার্স লিখেছে, বাংলাদেশে ১২ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি ভোটার আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দীর্ঘকাল ধরে দেশটির রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন গত মে মাসে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। এর আগে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।
হাসিনা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্য দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমরা নিজেরাই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাব।






















