ফেল থেকে পাস ১৪৭৯ জন, জিপিএ-৫ পেলেন ৫৫৫ শিক্ষার্থী
- আপডেট সময় : ১০:৪১:২০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
- / 2
# ঢাকা বোর্ডের রেজাল্টে সর্বোচ্চ পরিবর্তন
# বোর্ড চ্যালেঞ্জে বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন ২৩৩১ জনের
# যশোর বোর্ডে ফেল থেকে সরাসরি জিপিএ-৫ পেল ১ শিক্ষার্থী
# প্রশ্নের মুখে মূল্যায়ন পদ্ধতি
২০২৫ সালের এইচএসসি-আলিম পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জে সারাদেশে বড় ধরনের ফল পরিবর্তনের ঘটনা সামনে এসেছে। শিক্ষার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে পুনঃনীরিক্ষণ করে রোববার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৫৫ শিক্ষার্থী, আর ফেল থেকে পাস করেছেন ১ হাজার ৪৭৯ জন। মোট ২ হাজার ৩৩১ শিক্ষার্থীর ফল বিভিন্ন গ্রেডে পরিবর্তন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটেছে ঢাকা বোর্ডে। এমনকি যশোর শিক্ষা বোর্ডে একজন শিক্ষার্থী ফেল থেকে সরাসরি জিপিএ-৫ পাওয়ার নজিরও তৈরি হয়েছে। এসব পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আবারও প্রশ্ন উঠেছে উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে।
শিক্ষা বোর্ড সূত্র বলছে, এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল পুনঃনিরীক্ষণে রেকর্ডসংখ্যক আবেদন জমা পড়েছিল। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট ২ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। তারা চ্যালেঞ্জ করেছেন ৪ লাখ ২৮ হাজার খাতা।
ঢাকা বোর্ডের ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছে ৬৬ হাজার ১৫০ জন, যা থেকে জমা পড়েছে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০৬টি বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন। আর পুনঃনীরিক্ষণে সর্বোচ্চ ফল পরিবর্তনও হয়েছে ঢাকা বোর্ডে। এখানে ২ হাজার ৩৩১ জন শিক্ষার্থীর গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে। নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২০১ জন এবং ফেল থেকে পাস করেছেন ৩০৮ জন।
আর দ্বিতীয় সর্বাধিক আবেদন এসেছে কুমিল্লা বোর্ড থেকে, সেখানে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৯৯ হাজার ৫৭৬ জন। এরমধ্যে ২২ হাজার ৫০৩ জন শিক্ষার্থী ৪২ হাজার ৪৪টি খাতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেছেন। এই বোর্ডে ৫৮৭ জন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এদের মধ্যে ২৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন এবং ১০৮ জন ফেল থেকে পাস করেছেন।
চট্টগ্রাম বোর্ডে ১ লাখ ১ হাজার ৮৪৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২ হাজার ৫৯৫ জন আবেদন করেছেন ৪৬ হাজার ১৪৮টি খাতা চ্যালেঞ্জ করে। এখানে ফেল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৯৩ জন। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩২ জন।
রাজশাহী বোর্ডে আবেদন করেছে ২০ হাজার ৯২৪ জন। তাদের চ্যালেঞ্জকৃত খাতার পরিমাণ ৩৬ হাজার ১০২টি। এর বিপরীতে ১২১ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন এবং ৫৩ জন ফেল থেকে পাস করেছেন।
যশোর বোর্ডে ২০ হাজার ৩৯৫ জন শিক্ষার্থী ৩৬ হাজার ২০৫ টি বিষয়ে আবেদন করেছেন। এখানে ৭২ জন শিক্ষার্থী নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই বোর্ডের একজন শিক্ষার্থী ফেল থেকে সরাসরি জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
দিনাজপুর বোর্ডে আবেদনকারীর সংখ্যা ১৭ হাজার ৩১৮ জন এবং খাতার সংখ্যা ২৯ হাজার ২৯৭টি। খাতা চ্যালেঞ্জ করে নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩৪ জন আর ৮৫ জন শিক্ষার্থী নতুন করে পাস করেছেন।

ময়মনসিংহ বোর্ডে আবেদন করেছেন ১৫ হাজার ৫৯৮ জন, খাতার সংখ্যা ৩০ হাজার ৭৩৬টি। পুনঃনীরিক্ষণের পর এই বোর্ডে নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১০৩ জন এবং ফেল থেকে পাস করেছেন ২২৫ জন।
সিলেট বোর্ডে আবেদন করেছে ১৩ হাজার ৪৪ জন শিক্ষার্থী। এখানে পরিবর্তন হয়েছে ১৪১ জনের ফল। এর মধ্যে ৩১ জন নতুন করে পাস করেছেন এবং ৭ জন নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
আর বরিশাল বোর্ডে আবেদনকারীর সংখ্যা সবচেয়ে কম- মাত্র ৮ হাজার ১১ জন শিক্ষার্থী, মোট আবেদনপত্র ১৭ হাজার ৪৮৯টি। তবে এখানেও ১৮৫ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৯ জন এবং ফেল থেকে পাস করেছেন আরও ১৯ জন।
পুনঃনীরিক্ষণের উত্তরপত্রের চারটি দিক যাচাই করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- সব প্রশ্নে নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না, মোট নম্বর সঠিকভাবে যোগ হয়েছে কি না, ওএমআর শিটে নম্বর সঠিকভাবে তোলা হয়েছে কি না এবং বৃত্ত ভরাটে কোনো ভুল আছে কি না। এখানে পরীক্ষকের দেওয়া নম্বর পরিবর্তনের সুযোগ নেই। শুধু গণনা বা ওএমআর–সংক্রান্ত ভুলই সংশোধন করা হয়
অন্যদিকে, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ৯ হাজার ৭০১জন শিক্ষার্থী ৩১ হাজার ৮২৮টি খাতা পুনঃনীরিক্ষণের জন্য আবেদন করেন। এরমধ্যে ২০৪ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩৪ জন। ফেল থেকে পাস করেছেন ৪৫ জন।
আর কারিগরি বোর্ডে মোট ২৪১ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১১ জন এবং ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ১৫৮ জন।
শিক্ষাবোর্ডগুলোর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা বলছেন, গত মাসে প্রকাশিত এইচএসসি ফলাফলে যারা প্রত্যাশিত গ্রেড পাননি, তারা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অনলাইনে খাতা পুনঃনীরিক্ষণের আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে বোর্ডগুলো উত্তরপত্রগুলো নতুন করে যাচাই–বাছাই করে।

তাদের (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের) মতে, বোর্ড চ্যালেঞ্জে যারা আবেদন করেন, কেবল তারাই নিয়মমাফিক উত্তরপত্র পুনরায় যাচাই করানোর সুযোগ পান। ফলে মূল্যায়নজনিত ভুল সংশোধনেরও সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু যারা আবেদন করেন না, তারা পরীক্ষকের ভুল হিসাবেই থেকে যান। ফলে একই পরীক্ষায় অংশ নিলেও শুধুমাত্র আবেদনযোগ্যতার অভাব, অসচেতনতা বা আর্থিক কারণেই অনেক শিক্ষার্থী ভুল ফলাফলের বোঝা বয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়।
বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার এক কর্মকর্তা বলেন, পুনঃনীরিক্ষণের বড় মাত্রার ফল পরিবর্তনের এই প্রবণতা মূল্যায়নপদ্ধতির দুর্বলতাকেই নতুন করে সামনে আনে। খাতা মূল্যায়নে মান নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং তদারকির অভাবের কারণেই বারবার এমন ভুল দেখা দিচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে মূল্যায়নব্যবস্থার উপর সামগ্রিক আস্থা কমছে। আমি মনে করি, খাতা পুনর্মূল্যায়নের এই পরিসংখ্যান ভবিষ্যতে মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তাকে জোরালোভাবে তুলে ধরছে।
শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, পুনঃনীরিক্ষণের উত্তরপত্রের চারটি দিক যাচাই করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- সব প্রশ্নে নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না, মোট নম্বর সঠিকভাবে যোগ হয়েছে কি না, ওএমআর শিটে নম্বর সঠিকভাবে তোলা হয়েছে কি না এবং বৃত্ত ভরাটে কোনো ভুল আছে কি না। এখানে পরীক্ষকের দেওয়া নম্বর পরিবর্তনের সুযোগ নেই। শুধু গণনা বা ওএমআর–সংক্রান্ত ভুলই সংশোধন করা হয়।
আর চ্যালেঞ্জ হওয়া খাতাগুলো তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষক দিয়েই যাচাই করানো হয়। তারা মন্তব্যের ঘরে পরীক্ষকের করা ভুলগুলো লিখে বোর্ডে জমা দেন।
সার্বিক বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, চলতি বছর খাতা পুনঃনীরিক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়েছে, যাতে কোনো শিক্ষার্থী দ্বিতীয়বারও মূল্যায়ন বা বিভ্রাটে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে বিশেষ নজরদারি, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য আলাদা নির্দেশনা এবং ওএমআর যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বহুস্তরীয় যাচাই–বাছাই নিশ্চিত করা হয়েছে।
খাতা দেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষকদের গাফিলতি বা ভুল রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা এক দিনে দূর করা সম্ভব নয়, তবে আমরা ধীরে ধীরে ভুলের সংখ্যা কমিয়ে আনতে কাজ করছি। খাতা মূল্যায়নে দায়িত্বশীলতার ঘাটতি যেমন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি পুরো মূল্যায়ন ব্যবস্থার ওপর আস্থাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। এজন্য মূল্যায়নকারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, তদারকি বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিনির্ভর যাচাইপদ্ধতি আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, বোর্ড এ বছর খাতা মূল্যায়নে অনিয়ম বা অবহেলা ঠেকাতে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী বা বাইরের কাউকে দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করানোর মতো অনিয়ম প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি ছিল। মূল্যায়ন–সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশনা ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।
উল্লেখ্য, এ বছর সারাদেশের ৯ হাজার ১৯৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেন। গত ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত ফল অনুযায়ী তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ফেল করেছেন ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন (৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ)। ছাত্রীদের পাসের হার ৬২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ছাত্রদের ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।




















