বিশ্বের শীর্ষ ১০ বইমেলার কোনটি কোথায়
 
																
								
							
                                - আপডেট সময় : ০২:৫৪:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
- / 192
প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের হাত ধরে বইয়ের রূপও বদলে যাচ্ছে। মুঠোফোনে ডিজিটাল বা ই-বুক পড়া বা অডিওবুক শোনার প্রচলন বাড়ছে। তা সত্ত্বেও ছাপা বইয়ের চাহিদা এখনো শক্তিশালী। বিশ্বব্যাপী জমজমাট বইমেলাগুলো তারই প্রমাণ। দুনিয়ার নানা প্রান্তের বিখ্যাত বইমেলাগুলোয় স্থানীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি বৈশ্বিক একটা আমেজ ছড়িয়ে থাকে। এসব বইমেলা পাঠক, প্রকাশক আর সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা হয়ে ওঠে।
বইমেলার পরিসর, স্থায়িত্ব, অংশগ্রহণকারী দেশ ও স্বত্ব ও লাইসেন্স চুক্তির সংখ্যা, দর্শনার্থী সমাগম, সাংস্কৃতিক মূল্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে এখানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বইমেলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
- ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা

গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের কয়েক বছরের মাথায় ১৪৫৪ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার শুরু হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো এবং বড় বইমেলা। তবে বইমেলাটির আধুনিক সংস্করণ শুরু হয় ১৯৪৯ সালে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে অনুষ্ঠিত হয় এই বইমেলা। মেয়াদকাল পাঁচ দিন। প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই মেলায় অংশ নেয় ১০০টির বেশি দেশের ৭ হাজারের বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।
আন্তর্জাতিক স্বত্ব ও লাইসেন্স চুক্তির অন্যতম বড় কেন্দ্র এই বইমেলা। শেষের দুই দিন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখন খুচরা বইও বিক্রি হয়। পাঁচ দিনের এই মেলায় পেশাদার ও সাধারণ মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষের সমাগম হয়। প্রযুক্তি, ডিজিটাল বই, অডিওবুক—সবকিছুই এখানে গুরুত্ব পায়। সাহিত্যিকদের সেমিনার, সাক্ষাৎকার এবং স্বাক্ষর প্রদান অনুষ্ঠান, কিংবা প্রযুক্তি উদ্ভাবক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অংশগ্রহণ মেলাকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
- লন্ডন বইমেলা

এপ্রিল মাসে লন্ডনের অলিম্পিয়া প্রদর্শনী কেন্দ্রে আয়োজিত হয় এই বইমেলা। প্রায় ৬০টির বেশি দেশের প্রকাশক, সাহিত্যিক ও এজেন্টরা এতে অংশ নেন। এই মেলায় মূলত আন্তর্জাতিক স্বত্ববাণিজ্য ও পাণ্ডুলিপি কেনাবেচাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বই প্রকাশের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও কর্মশালা হয়।
শিক্ষামূলক প্রকাশনা, বৈজ্ঞানিক সাময়িকী এবং শিশুতোষ বইয়ের জন্যও বিশেষ প্যাভিলিয়ন থাকে। এটি মূলত ব্যবসায়িক বইমেলা হলেও সাহিত্যিক পরিবেশনা, লেখকদের সাক্ষাৎকার এবং স্বাক্ষর প্রদান অনুষ্ঠান মেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিন দিনব্যাপী এই বইমেলায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ঢুঁ মারেন।
- বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা

প্রতিবছর আগস্ট মাসে আয়োজিত হয় এই বইমেলা। এশিয়ার সবচেয়ে বড় পেশাদার বইমেলা হিসেবে পরিচিত, যেখানে প্রায় ৯০টি দেশ অংশ নেয়। চীনা ভাষার বই ছাড়াও ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ থাকে এখানে।
প্রযুক্তিনির্ভর প্রকাশনা, যেমন ই-পাবলিশিং, অডিওবুক ইত্যাদির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি মূলত আন্তর্জাতিক স্বত্ববাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, যেখানে বই বিক্রির চেয়েও বেশি গুরুত্ব পায় আধেয় বিনিময় (কনটেন্ট শেয়ারিং) ও আন্তর্জাতিক চুক্তি। পাঁচ দিনব্যাপী এই বইমেলায় দুই লাখের বেশি দর্শনার্থীর সমাগম হয়।
- তেহরান আন্তর্জাতিক বইমেলা

মে মাসে তেহরানের ইমাম খোমেনি মসজিদ চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় এই বইমেলা। এটি ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ সাংস্কৃতিক আয়োজন। ইসলামি সাহিত্য, ধর্মীয় গবেষণা ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের বই এখানে বেশি গুরুত্ব পায়। তবে শিশুতোষ, প্রযুক্তি ও আধুনিক সাহিত্যের বইয়েরও উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
দেশি-বিদেশি প্রায় দুই হাজার প্রকাশক অংশ নেন এই মেলায়। এতে ইংরেজি, আরবি, ফরাসি, জার্মান, চীনা, কোরীয়, রুশ ও জাপানি ভাষার বই পাওয়া যায়। সাহিত্যিক অনুষ্ঠান, আলাপচারিতা ও কবিতা পাঠ এখানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ১০ দিনব্যাপী এই বইমেলায় দৈনিক সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ ঘুরতে আসেন।
- হংকং বইমেলা
হংকং বইমেলা প্রতিবছর জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৫ সালের বইমেলা ১৬-২২ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। এটি হংকং কনভেনশন অ্যান্ড এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম বইমেলা হিসেবে পরিচিত। এতে বই প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও সাহিত্যপ্রেমীরা অংশ নেন। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট থিম নিয়ে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা বইমেলার বিষয়বস্তু ও কার্যক্রম নির্ধারণ করে।
এই বইমেলায় ৬০০টিরও বেশি সেমিনার ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং প্রায় ৭৬০টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হংকং বইমেলায় প্রায় ৯ লাখ ৯০ হাজার দর্শনার্থী অংশ নিয়েছিলেন, যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। তবে ২০১৮ সালে সর্বাধিক ১০ লাখ ৪০ হাজার দর্শনার্থী মেলাটিতে ঢুঁ মেরেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড।
- আবুধাবি আন্তর্জাতিক বইমেলা

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় বইমেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর মে মাসে অনুষ্ঠিত হয়। আরবি ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, ফারসি ও অন্যান্য ভাষার বইও পাওয়া যায়। সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের বইমেলায় জায়গা পায়।
আরবি সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়। আরব সাহিত্য পুরস্কার ও অনুবাদ কর্মসূচি এই মেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখান থেকে অনেক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা আরবি ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেয়। সাত দিনব্যাপী এই বইমেলায় প্রতিবছর গড়ে আড়াই লাখ মানুষ অংশ নেয়।
- বোগোতা আন্তর্জাতিক বইমেলা (কলম্বিয়া)

লাতিন আমেরিকার অন্যতম বড় বইমেলা, যা প্রতিবছর এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত হয়। স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরাই এর মূল লক্ষ্য। লেখক-পাঠকের সরাসরি আলাপচারিতা, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এবং শিশু সাহিত্য কার্যক্রম এই মেলার আকর্ষণ। প্রতিবার একটি অতিথি দেশকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়, যেটার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রদর্শনী থাকে আলাদাভাবে।
স্থানীয় প্রকাশকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ এই মেলাকে বিশ্বমানের করে তোলে। ১৭ দিনব্যাপী এই মেলায় বছরে গড়ে ছয় লাখ মানুষ আসেন।
- কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা
এশিয়ার অন্যতম বড় এবং জনপ্রিয় বইমেলা এটি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার সল্টলেক বা মিলনমেলায় হয় এর আয়োজন। এখানে প্রতিবার একটি থিম দেশ থাকে, যেটির সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ওপর আলোচনা করা হয়। বাংলা ভাষার লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের জন্য এটি একটি চমৎকার উৎসব। ১২ দিনব্যাপী এই মেলায় প্রায় ২০ লাখ দর্শনার্থী আসেন। নতুন বই প্রকাশ, সাহিত্য আলোচনার আসর, কবিতাপাঠ, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে এটি একটি প্রাণবন্ত মেলা। বিভিন্ন দেশের লেখকেরাও এতে অংশ নেন।
- কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা

আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বইমেলা, যা জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এটি আরবি বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো বইমেলাও বটে। সাহিত্যের পাশাপাশি ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস এবং রাজনীতিবিষয়ক বইয়ের জন্য কায়রো মেলার খ্যাতি রয়েছে। আরবি সাহিত্যিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক লেখকেরাও এতে অংশ নেন। প্রতিবছর এত গড়ে প্রায় ৪০ লাখ দর্শক আসেন। মিসরীয় সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রদর্শনীও হয় এই মেলায়, যা একে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করে। ১৪ দিনব্যাপী এই মেলা ৫৫ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়।
- অমর একুশে গ্রন্থমেলা
বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলা ছাড়া বিশ্বে আর কোনো বইমেলা মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় না। ফেব্রুয়ারি মাসের এই মেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকাশনা উৎসব। প্রতিদিন প্রকাশিত হয় অনেক নতুন বই। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সরাসরি সংযোগ ঘটে। বই বিক্রি ছাড়াও সাহিত্য আলোচনা, কবিতা পাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে পুরো মাসব্যাপী। মাসব্যাপী এই বইমেলায় প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।
 
																			 
																		























