৭৬১ কোটি টাকার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ভোটের মাঠে কাজী রফিক!
- আপডেট সময় : ১০:০৬:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
- / 3
জনসেবার অঙ্গীকার নিয়ে ভোটের মাঠে নামলেও কাজী রফিকুল ইসলামের পিছু ছাড়ছে না ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’র তকমা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ও এক্সিম ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা বছরের পর বছর অনাদায়ী রেখে তিনি এখন বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি–সোনাতলা) আসনের ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। রাজনৈতিক প্রভাব আর আদালতের স্থগিতাদেশে এতদিন খেলাপি পরিচয় আড়াল করে রাখলেও, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের কঠোর নিয়ন্ত্রণ তার নির্বাচনী ভাগ্য নির্ধারণে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে—৭৬১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে তিনি কি আদৌ পারবেন সংসদের চৌকাঠ মাড়াতে?
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আদালতের তথ্য অনুযায়ী, ওই দুই ব্যাংকের কাছে কাজী রফিকুল ইসলাম এবং তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের কাছে তার খেলাপি ঋণ ৪৮৪ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে ২৭৭ কোটি টাকা।
দীর্ঘদিন ধরে ঋণ পরিশোধ না করায় তাকে দুই ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো আদালতে মামলা করেছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ও এক্সিম ব্যাংকের কাছে কাজী রফিকুল ইসলাম এবং তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের কাছে তার খেলাপি ঋণ ৪৮৪ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে ২৭৭ কোটি টাকা
এদিকে, বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েও জাতীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ঋণখেলাপিদের নির্বাচন করার সুযোগ নেই।

ব্যাংক ও আদালতের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কাজী রফিকুল ইসলাম ‘ওকে গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক। ২০০৯ সালে ৪০ কোটি টাকা ব্যক্তিগত ঋণের মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়। ব্যাংকে তার প্রধান ব্যবসা হিসেবে ‘ভূমি উন্নয়ন ও ইমারত নির্মাণ’ দেখানো হয়। পরবর্তীতে তিন দফায় ঋণ বাড়ানোর মাধ্যমে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটিতে তার মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ কোটি টাকা। বর্তমানে সুদ-আসলসহ ওই ব্যাংকের পাওনা ২৭৭ কোটি টাকা, যা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ২০১৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত সুদ-আসলসহ পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৭৭ কোটি টাকা। বর্তমানে গ্রাহকের ঋণটি মন্দমানে (খেলাপি) শ্রেণিকৃত। ঋণটি মন্দমানে থাকায় তার বিরুদ্ধে আদালতে ‘সিআর-৩৮৭২/২৪’ নম্বরের একটি মামলা করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে, তাকে যাতে ঋণখেলাপি হিসেবে দেখানো না হয়, সেজন্য তিনি আদালত থেকে স্থগিতাদেশ (স্টে অর্ডার) নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, গ্রাহক ঋণটি নীতিমালা অনুযায়ী পুনঃতফসিল করতে এসেছিলেন। তবে, তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম বর্তমানে সচল না থাকায় ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্য অনুযায়ী, কাজী রফিকুল ইসলামের নামে ব্যক্তিগতভাবে দুটি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ২৭৭ কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংকে ৭৭ কোটি টাকা। এই দুটি ঋণের বিপরীতেই তিনি আদালতের মাধ্যমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রেখেছেন।

একই সঙ্গে সিআইবি তথ্য বলছে, ‘ওকে প্রপার্টিজ’ কোম্পানির নামে এক্সিম ব্যাংকে ২০৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এই ঋণের বিষয়েও তিনি আদালতের মাধ্যমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিয়েছেন।
এক্সিম ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, কাজী রফিকুল ইসলামের ‘ওকে গ্রুপ’-এর নামে মোট ঋণ রয়েছে ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘ও.কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’-এর নামে ৭৭ কোটি টাকা, ‘ও.কে এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড’-এর নামে ২০৩ কোটি টাকা এবং ‘ও.কে প্রপার্টিজ’-এর নামে ২০৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।
কাজী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরও যেসব মামলা
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গুলশান ব্রাঞ্চে মেজর খন্দকার নুরুল আফসার নামে এক ব্যক্তির ৩৯৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় নুরুল আফসারসহ আরও আটজনকে আসামি করা হয়েছে।
অর্থঋণ আদালতের ‘৬৬৪/২৫’ মামলার এজাহার সূত্রে দেখা যায়, এই মামলায় করপোরেট গ্যারান্টর হিসেবে আসামি রয়েছেন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। একই মামলায় তৃতীয় আসামি হিসেবে পার্সোনাল ও করপোরেট জামিনদার রয়েছেন কাজী রফিকুল ইসলাম। রেন্স রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানও এই মামলার আসামি।
মামলার বিবরণীতে দেখা গেছে, বর্তমানে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণের (প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট) পরিমাণ ১৪৮ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সুদ ও অন্যান্য চার্জ বাবদ। গ্রাহক ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই ঋণের বিপরীতে মাত্র ১৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন।

এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রাহক ঋণটি নিয়েছেন পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে। বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করেও রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকারদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণগুলোকে নিয়মিত (রেগুলার) দেখাতে বাধ্য করেছেন।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে, তারা আদালতের মাধ্যমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রেখেছেন।
খেলাপি প্রার্থীদের বিষয়ে আইন যা বলছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন জানতে চায় একজন গ্রাহকের সিআইবি স্ট্যাটাস কী। উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিলেও তিনি খেলাপি গ্রাহক হিসেবেই গণ্য হন। তবে, আদালতের আদেশের কারণে সিআইবি রিপোর্টে তার খেলাপি ঋণের পাশে স্থগিতাদেশের বিষয়টি উল্লেখ থাকে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের উচিত নয় একজন ঋণখেলাপিকে প্রার্থী করা। কারণ, প্রার্থীর নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন ঋণখেলাপি সাধারণ মানুষের কাছে গেলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, কোনো সংসদ সদস্য প্রার্থী যদি ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক হন, তবে আদালতের কাছেও তিনি খেলাপি। আদালত হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য সিআইবিতে খেলাপি না দেখানোর নির্দেশনা দিতে পারেন, তবে আমরা নির্বাচন কমিশনকে জানাব যে ওই গ্রাহক খেলাপি এবং তিনি আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং আচরণবিধিতে সংশোধনী আনতে যাচ্ছে ইসি। কোনো গ্রাহক আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে নির্বাচন করতে পারলেও, নির্বাচনের পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি জানিয়েছেন, এবার কেউ আদালতের স্থগিতাদেশ নিলেও ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) তাকে খেলাপি হিসেবেই দেখানো হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সিআইবিতে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তি জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার যোগ্য নন।
কে এই কাজী রফিকুল ইসলাম
কাজী রফিকুল ইসলাম ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বার একই আসনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন।
বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপির বিষয়ে বক্তব্য জানতে কাজী রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

























