নিজস্ব প্রতিবেদন : বৈধ অভিবাসন ও মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চায় ইতালি। বাংলাদেশও চুক্তিটি করতে রাজি। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাতেও পিয়ান্তেদোসির আসন্ন ঢাকা সফরে ওই চুক্তির আওতায় ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড মবিলিটি’ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুদিনের সফরে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোমবার (৫ মে) দুপুরে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। সফরের শুরুর দিন তিনি বেশ ব্যস্ত সময় সময় পার করবেন।
এদিন, ইতালির মন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকে সমঝোতা স্মারকটি সই হতে পারে। এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন পিয়ান্তেদোসি।
এর বাইরে ঢাকা সফরকালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলেরসঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মূল লক্ষ্য জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, অভিবাসন এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা। অভিবাসন ইস্যুতে দুই প্রান্তে যে ধরনের অপরাধ হয়, সেগুলো যেন না হয়; তার জন্য সহযোগিতা। যেমন-তথ্য আদান-প্রদান, ডাটা শেয়ারিং। অভিবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ইতালি খুব গভীরভাবে কাজ করবে। এজন্য আমরা অনেক দিন ধরে ইতালির সঙ্গে একটা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছি। তাদের দিক থেকে এই চুক্তি করার বিষয়ে আগ্রহ বেশি। তারা চাইলে আমরাও প্রস্তুত আছি।
ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাতেও পিয়ান্তেদোসি
অভিবাসন নিয়ে দুপক্ষ যে চুক্তি করতে চাইছে তার আওতায় কি কি থাকবে, জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, প্রথমত- নিয়মিত ও বৈধ অভিবাসন নিশ্চিত করা। বৈধ পথে কর্মী পাঠানো, বিশেষ করে দক্ষ কর্মী। পাশাপাশি অবৈধ পথে কর্মীরা যাওয়া বন্ধ করা। আর এক্ষেত্রে উভয়পক্ষ একসঙ্গে কাজ করতে চায়।
সরকারের দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালিতে যাওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রবল। ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অনেক বাংলাদেশি মারাও যাচ্ছেন। সে কারণে বাংলাদেশ থেকে বৈধপথে ইতালি যাওয়ার জন্য দেশটির পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। ইতালির মন্ত্রী বৈধ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা করবেন বলে আমরা আশা করছি।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ইতালির নতুন অভিবাসন নীতির আওতায় প্রথমবারের মতো আলবেনিয়া হয়ে এক অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটি। অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ইতালির ক্ষমতায় আসেন জর্জা মেলোনির সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের আলবেনিয়ায় পাঠানোর নিয়ম চালু করেন তিনি। অবৈধ অভিবাসন নিয়ে ইতালির কঠোর অবস্থানের কথা সরকারের সংশ্লিষ্টদের তুলে ধরবেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দুদেশ নিয়মিত ও মানবপাচার বন্ধে যে চুক্তির কথা ভাবছে, সেটি চূড়ান্ত হলে ইতালিতে কোনো অবৈধ কর্মী থাকলে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
রোমের বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ইতালি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী। তাদের কর্মীর চাহিদা রয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বৈধ উপায়ে কয়েক হাজার কর্মী নিতে চায় ইতালি। সঙ্গে কৃষিকাজের জন্য মৌসুমি কর্মীও নেবে। কিন্তু তারা মানবাপাচার বা অবৈধ কর্মীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে।
ইতালি যেতে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার কর্মী ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। যাদের বড় একটি অংশ জাল কাগজপত্র নিয়ে আবেদন করার কারণে ভিসা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দফায় দফায় ভিসা আবেদনকারীরা আন্দোলনও করেছে। ইতালি এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের আশ্বাসের কথা বলে আসছে।
এ সমস্যার সমাধান অগ্রগতি এবং ইতালির মন্ত্রীর সফরে বিষয়টি তোলা হবে কিনা, জানতে চাইলে দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, ইতালিতে ৬০ হাজার কর্মী ভিসার জন্য আবেদন করেছে। যার বড় একটি অংশ জাল কাগজ নিয়ে আবেদন করা। যার জন্য এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। ইতালির দিক থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা দূতাবাসে লোকবল বাড়িয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এত মানুষের তথ্য যাচাই-বাছাই করা খুব কঠিন ব্যাপার। এটা নিয়ে ইতালিও বিপদে আছে। চাইলে একজন কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই না করে একজন ভিসা প্রার্থীর আবেদন বাতিল করতে পারে না। যদি কোনো কারণে সঠিক তথ্য থাকার পরও কারও ভিসা বাতিল হয় সেক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তা বরখাস্ত হবেন। আমাদের দিক থেকে এ সমস্যার সুরাহার অনুরোধ থাকবে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নেরে জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ইতালি যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি কর্মী যাদের ভিসা অপেক্ষমাণ (পেন্ডিং) আছে, সেটির সমাধান ইতালির হাতে। আর এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতালিকে অবিরাম চাপ দেওয়া হচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ইতালির বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগে আছি। কিছু সমস্যা আছে যেটাতে আমাদেরও দোষ আছে। নিজেদের ত্রুটি, স্বীকার করা উচিত। কারণ, ৬০ হাজার মানুষের কাগজপত্র ইস্যু হয়েছে সেই কাগজপত্রের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে ভিত্তি সঠিক নয় বলে আমরাও জানি, ইতালিয়ানরাও সেটাকে চিহ্নিত করেছে।
ইতালি যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি কর্মীদের উদ্দেশে তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, আমার সহানুভূতি আছে যারা সাফার করছে। আমি নিশ্চিত তাদের মধ্যে অনেক সঠিক মানুষ আছে। কিন্তু যেটা হয়, সঠিকের সঙ্গে বেঠিক ঢুকে যায় তখন সবগুলো চেকআপ করতে হয়। আর এতে করে সঠিক যারা তাদের সাফার করতে হয়, সেটাই ঘটছে এখানে। এখন তারা যদি আন্দোলন করে তাহলে এর মাধ্যমে সমাধান হবে না। এই সমস্যার সমাধান ইতালিয়ানদের হাতে এবং আমরা তাদের অবিরাম চাপ দিয়ে যাচ্ছি।