বহুজাতিক নভো নরডিস্কের কর ফাকি ৩০ কোটি টাকা

বহুজাতিক কোম্পানি নভো নরডিস্ক ফার্মা (প্রা.) লিমিটেড। ডেনমার্কভিত্তিক নভো নরডিস্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনসুলিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আয়কর পরিহারের অভিযোগ উঠেছে। অননুমোদনযোগ্য খরচ আয়ের সঙ্গে যোগ না করে প্রায় ৩০ কোটি টাকার আয়কর পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে। দুই করবর্ষে এ বিপুল পরিমাণ আয়কর পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটির আয়কর ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে নভো নরডিস্কের পরিহার করা আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করতে সুপারিশ করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এনবিআরের আওতাধীন ৯টি কর অঞ্চলের অধীনে ১৫টি কর সার্কেলের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ২০১৮-২০ করবর্ষের (২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ) ওপর আয়কর নির্ধারণের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট (এআইআর) সম্পন্ন করেছে। এতে ৪৫১ কোটি ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩১৪ টাকার অনিয়ম উঠে আসে। এর মধ্যে কর অঞ্চল-২, ৩, ৫, ৮, ৯ ও ১০ রয়েছে। নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নভো নরডিস্ক ফার্মা (প্রা.) লিমিটেড একটি, যার ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ করবর্ষে প্রায় ৩০ কোটি টাকার আয়কর পরিহার বা অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নভো নরডিস্ক ফার্মা (প্রা.) লিমিটেড কর অঞ্চল-৮-এর অধীন ১৫৬ সার্কেলের কোম্পানি করদাতা। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ করবর্ষে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ৮২ বিবি ধারায় রিটার্ন দাখিল করেছে। এ দুই করবর্ষে উপকর কমিশনার কর্তৃক নিরূপিত আয় দেখানো হয়েছে ১৮৪ কোটি ৩৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৫ টাকা। কিন্তু রাজস্ব অডিট দুই করবর্ষে প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় পেয়েছেন ২৬৮ কোটি ৭৭ লাখ ৯২ হাজার ৪৫ টাকা। দুই করবর্ষে প্রতিষ্ঠানটি অননুমোদনযোগ্য খরচ ৮৪ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ টাকা আয়ের সঙ্গে যোগ করেনি।

আরও বলা হয়, ৮৪ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ টাকা ‘কস্ট অব গুডস সোল্ড’ খাতের। প্রতিষ্ঠানটি এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড পণ্য (কাঁচামাল) কিনেছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ৫২ ধারা ও বিধি-১৬ ক্লজ (বি) অনুযায়ী ‘পারচেজ অব প্রোডাক্ট’ ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কোনো উৎসে কর কর্তন করেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ‘কস্ট অব গুডস সোল্ড’ খাতে ৮৪ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ টাকা খরচ হিসেবে দাবি করে। কিন্তু দাবিকৃত খরচের ওপর উৎসে কর কর্তনের কোনো চালান বা প্রমাণক দেয়নি। নিরীক্ষার সময় কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। ফলে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ৩০ (এএ) ধারা অনুযায়ী, এই আয় অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে গণ্য হবে এবং তা অন্যান্য উৎস থেকে আয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগযোগ্য।

আরও বলা হয়, ওই দুই করবর্ষে কোম্পানির করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ। সে অনুযায়ী ৮৪ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ টাকার ওপর কর ২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৫৫ টাকা। কোম্পানি থেকে প্রযোজ্য আয়কর আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরকে অবহিত করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে নভো নরডিস্ক ফার্মা (প্রা.) লিমিটেডের ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করা হয়। বিষয়টি উল্লেখ করে ই-মেইল করা হয়। পরে ঢাকা অফিসের কর্মকর্তারা নভো নরডিস্কের প্রধান কার্যালয় মালয়েশিয়ায় যোগাযোগ করেন। ফিরতি ই-মেইলে ফাঁকির বিষয়ে জানানো হয়, ‘আপনাকে আমাদের বক্তব্য জানতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। ডেনমার্কভিত্তিক নভো নরডিস্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনসুলিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যা পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৩ দশমিক ৩ কোটি রোগীকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা দিয়ে আসছে।’

ই-মেইলে আরও বলা হয়, ‘আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ব্যবসায়িক নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করে চলি। যার মধ্যে কর, ভ্যাট এবং কাস্টমস আইন অন্যতম। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অ্যাকাউন্টিং নীতিমালা মেনে চলি, যেখানে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের সুযোগ নেই। আমাদের অ্যাকাউন্টিং রেকর্ডগুলো সুপরিচিত অডিট ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষণ করা হয় এবং প্রতিটি লেনদেনের জন্য আমাদের কাছে সহায়ক নথি রয়েছে, যা আমরা আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষণের সময় এবং ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার সময় জমা দেই।’

আরও বলা হয়, ‘মেইলে উল্লিখিত আর্থিক বছর ২০১৬ থেকে ২০১৮ (কর বছর ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০) এর জন্য ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার সময় আমরা সব প্রাসঙ্গিক নথি কর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। অর্থবছর ২০১৬-এর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার সময় সব প্রাসঙ্গিক নথিসমূহ জমা দেয়া হয়েছিল, যার প্রাপ্তি স্বীকার চিঠি আমাদের কাছে রয়েছে এবং এর ভিত্তিতে কর প্রত্যয়নপত্র জারি করা হয়েছে। কর বছর ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ নিয়ে কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কর আপত্তি প্রক্রিয়াধীন, যার ফলে বিচারাধীন বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে অপারগ। উল্লেখ্য, কর বছর ২০১৮-১৯-এর কর আপত্তির প্রথম রায় আমাদের পক্ষে প্রদান করা হয়েছে।’

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title