ঈদুল আজহা : কোরবানির বিধিবিধান

প্রাইম টিভি বাংলা : মুসলমানের উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈদুল আজহা। যে অবিস্মরণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে ঈদুল আজহা প্রতি বছর উদযাপিত হয়, তার সূত্রপাত ঘটেছিল চার হাজার বছর আগে।ঈদুল আজহার মৌলিক শিক্ষা হলো তাকওয়া ও খোদাভীতি। শুধু পশু কোরবানি নয় বরং নিজেদের মধ্যে যাপিত যেসব পশুত্ব, পাশবিকতা ও কুপ্রবৃত্তি আছে সেগুলোকে দমন করে এমন সংকল্প করা যে, প্রয়োজনে প্রাণাধিক প্রিয়বস্তুকেও আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে সদাপ্রস্তুত থাকা।
কোরবানি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। হাদিসে কোরবানির অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। তবে এসব ফজিলতপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত হলো এখলাস। কোরবানি একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে, লোক দেখানো বা পার্থিব কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না। যদি আল্লাহতায়ালাকে পাওয়ার আশা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানি করা হয় তাহলে সওয়াবের বিপরীতে গুনাহের বোঝা বহন করতে হবে। আর কোরবানিকে সঠিকভাবে আদায় করতে এ সংক্রান্ত মাসায়িল জানা আবশ্যক। তাই জেনে নিন কোরবানির বিধিবিধান।

যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব

১. যার কাছে ঈদুল আজহার দিনগুলোতে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ ছাড়া সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা সমপরিমাণ সম্পদ থাকবে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ মাল পূর্ণ এক বছর থাকা জরুরি নয়। বরং কোরবানির শেষদিন সূর্যাস্তের আগে নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে কোরবানি ওয়াজিব। নেসাবের বর্তমান বাজারদর হিসেবে যার কাছে ৪৯ হাজার টাকার সম্পদ থাকবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। রূপার বাজারদর অনুযায়ী এই হিসাব করা হয়েছে। ৯৩৩ টাকা বর্তমানে রূপার ভরি। সে হিসাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার হিসাব ধরা হয়েছে। তবে এই হিসাব কমবেশি হতে পারে।
২. মালদার হলেও মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। তবে কোরবানির দিনগুলোর মধ্যে ফিরে এলে কোরবানি করা ওয়াজিব।
৩. জীবিকা নির্বাহের জন্য যে পরিমাণ জমি ও ফসলের প্রয়োজন তা থেকে অতিরিক্ত জমি ও ফসলের মূল্য অথবা যে কোনো একটির মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে কোরবানি করা ওয়াজিব।
৪. নাবালক সন্তানের পক্ষ থেকে কোরবানি করা অভিভাবকের ওপর ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব। সে সন্তান মালদার হলেও তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়।
৫. মালদার ব্যক্তি ১২ জিলহজ পর্যন্ত যদি কোরবানি না করে এবং যদি পশু ক্রয় করে থাকে, তাহলে ওই পশুটিই সদকা করতে হবে। পশু ক্রয় না করে থাকলে কোরবানি পরিমাণ টাকা সদকা করতে হবে।
৬. একই পরিবারের সব সদস্য পৃথক পৃথকভাবে নেসাবের মালিক হলে সবার ওপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব।
৭. কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানির মানত করলে সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে কোরবানি করা ওয়াজিব।
অন্যের পক্ষে কোরবানি করা
হজরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হজরত আলীকে (রাঃ) ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর যেন তিনি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করেন। তাই হজরত আলী (রাঃ) প্রতি বছর দুটি কোরবানি করতেন। একটি নিজের, অপরটি হজরত রাসূলুল্লাহের (সাঃ) পক্ষ থেকে। এ থেকে বোঝা গেল মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কেউ কোরবানি করলে তা সহিহ হবে এবং এর সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পেঁৗছবে। বরং কোরবানির দিনে ইসালে সওয়াবের জন্য মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে টাকা-পয়সা দেওয়া থেকে কোরবানি করা উত্তম।
কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে অনুমতি ছাড়া ওয়াজিব কোরবানি সহিহ হবে না বরং পশু শরিক করলে সবার কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে। তবে নফল কোরবানি অনুমতি না নিলেও সহিহ হবে।

যেসব পশু কোরবানি করা জায়েজ

১. গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ।
২. ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক বছর বয়সী হওয়া আবশ্যক। তবে যদি ভেড়া ও দুম্বা এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে ছয় মাসেরটিও দেখতে এক বছরের মনে হয়, তাহলে এটাও কোরবানি করা বৈধ। আর গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে দুই বছর এবং উটের জন্য পাঁচ বছর বয়সী হওয়া আবশ্যক।
৩. শিংয়ের গোড়া ভেঙে যাওয়ায় মগজে যদি আঘাত পেঁৗছে তাহলে তা দ্বারা কোরবানি বৈধ হবে না। তবে জন্মগতভাবেই শিং না থাকা এবং মধ্যখানে ভেঙে যাওয়া পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ।
৪. অন্ধ পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয় এবং দাঁত না থাকা পশুর দ্বারা কোরবানি জায়েজ নেই। তিন ভাগের একভাগ লেজ নেই এমন পশু দ্বারাও কোরবানি দুরস্ত নয়।
৫. এমন দুর্বল পশু যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে বা কোরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম তার দ্বারা কোরবানি সহিহ নয়।
৬. মোটাতাজা পশু দ্বারা কোরবানি করা মুস্তাহাব। যে কোনো প্রকার ত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি না করা ভালো।
৭. খরিদ করার পর পশুতে যদি এমন কোনো দোষ পাওয়া যায় যার কারণে কোরবানি সহিহ নয়, তাহলে ধনীর জন্য পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়, গরিবের জন্য জায়েজ। কোরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা অথবা জবাই করার সময় নিজে উপস্থিত থাকা মুস্তাহাব।

কোরবানি করার সময়

১. জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদের জামাত পড়ার পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কোরবানি করা যায়। তবে ১০ তারিখে অর্থাৎ কোরবানির প্রথমদিনই করা উত্তম। তাই প্রয়োজন ছাড়া দেরি না করা ভালো।
২. উত্তমরূপে জবাই করতে কোনো অসুবিধা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে রাতে কোরবানি করা মাকরুহ।
৩. ঈদের নামাজ আদায় করার পর কোরবানি করতে হবে। নামাজের আগে কোরবানি করে ফেললে ঈদের জামাত আদায়ের পর আবার কোরবানি করতে হবে।
৪. যদি শহরে একাধিক ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় তাহলে যে কোনো এক স্থানে নামাজ আদায় হয়ে গেলে সব স্থানেই কোরবানি করা সহিহ। যদিও কোরবানিদাতা এখনও ঈদের আদায় করেনি।
শরিকানা কোরবানি
১. ছাগল, ভেড়া ও দুম্বাতে শরিকানা সহিহ নয়। এসব পশু শুধু একজনের পক্ষ থেকেই কোরবানি করা সহিহ।
২. গরু, মহিষ ও উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে, বেশি জায়েজ নয়। তবে কম হলে কোনো অসুবিধা নেই।
৩. সাতজন শরিক হলে প্রত্যেকের অংশ সাত ভাগের এক ভাগ হতে হবে। কারও অংশ কম হলে সবার কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে।
৪. কোনো ব্যক্তি যদি কোরবানির পশু খরিদ করার সময় এরূপ নিয়ত করে যে যদি কোনো শরিক পাই, তাহলে নিয়ে নেব; তখন পরে শরিক করাতে কোনো আপত্তি নেই। তবে যদি ক্রয় করার সময় এরূপ নিয়ত না থাকে আর সে ব্যক্তি ধনী হয়, তাহলে শরিক করতে পারবে; গরিব হলে পারবে না। গরিব ব্যক্তি যদি শরিক করতে চায় তাহলে ক্রয় করার আগেই তা ঠিক করতে হবে।
৫. শরিকদের মধ্যে কেউ গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোরবানি করলে কারও কোরবানি সহিহ হবে না।
৬. কোরবানির পশুর মধ্যে আকিকার জন্য শরিক হতে পারবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই।

কোরবানির গোশত সংক্রান্ত মাসায়িল

১. মানত করা কোরবানির সম্পূর্ণ গোশত সদকা করতে হবে। নিজেরা গরিব হলেও খেতে পারবে না এবং কোনো মালদার ব্যক্তিকেও দেওয়া যাবে না।
২. মৃত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানি করলে নিজেরা গোশত খেতে পারবে। তবে মৃত ব্যক্তি ওসিয়ত করে গেলে সম্পূর্ণ গোশত সদকা করা ওয়াজিব।
৩. কোরবানির গোশত দ্বারা কোনো প্রকার মজুরি দেওয়া জায়েজ নয়।
৪. খাওয়ানোর শর্তে রাখা শ্রমিককে মজুরি বাবদ কোরবানির গোশত খাওয়ানো জায়েজ নয়। তবে অন্য তরকারি যথেষ্ট পরিমাণ থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। আর কোরবানির গোশত মজুরি হিসেবে খাইয়ে থাকলে সে পরিমাণ গোশতের মূল্য সদকা করতে হবে।
৫. কোরবানির গোশত বণ্টনের মুস্তাহাব তরিকা হলো_ গোশতকে তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য রাখবে, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে হাদিয়া দেবে এবং আরেকভাগ গরিব-মিসকিনদের দান করবে। তবে কেউ ইচ্ছে করলে সম্পূর্ণই নিজের জন্য রাখতে পারবে।
৬. ঈদের দিন সকালে কিছু না খেয়ে কোরবানির গোশত দিয়ে খাওয়া শুরু করা মুস্তাহাব।

কোরবানির চামড়া

১. কোরবানির চামড়া বিক্রি না করে নিজে ব্যবহার করতে পারবে বা মালদার কোনো ব্যক্তিকে উপহার দিতে পারবে এবং গরিব-মিসকিনকেও দান করতে পারবে।
২. চামড়া বিক্রয় করে ফেললে এর মূল্য গরিব-মিসকিনদের সদকা করা ওয়াজিব।
৩. কোরবানির চামড়ার মূল্য মসজিদ-মাদ্রাসায় বা জনকল্যাণমূলক কোনো কাজে লাগানো যাবে না। গরিব-মিসকিনদেরই দান করতে হবে।
৪. চামড়া বিক্রির টাকা মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের দান করা উত্তম। কেননা এতে দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যায়। সদকা করার সওয়াব এবং দ্বীনের পথে সহযোগিতা করার সওয়াব।
৫. কোরবানির চামড়ার মূল্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নয়। আমাদের দেশে অনেকেই অজ্ঞতাবশত কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে চামড়া দিয়ে থাকেন। এরূপ দিয়ে দিলে পরে এর মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।
৬. সব ধরনের দান-খয়রাতে নিজের গরিব আত্মীয়স্বজনের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।
তাকবিরে তাশরিকের হুকুম
৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্তে ফরজ নামাজের পর এই তাকবির পড়বে। ভুলে নামাজের সময় না পড়লে অন্য সময় পড়া ওয়াজিব পালন হয়ে যাবে।
তাকবির পুরুষ জোড়ে পড়বে, আর মহিলারা আস্তে। তাকবিরে তাশরিক হলো_ ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title