বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের নতুন উদ্ভাবন : গৃহিনীদের রান্নায় যোগ হচ্ছে কাঁচা পেঁয়াজের পাউডার

দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: গৃহিনীদের রান্না-বান্না করতে কতই না উপকরণ লাগে। রান্নার কাজে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, রসুন- পেঁয়াজবিহীন স্বাদ পাওয়া অনেকটাই ভাবা মুশকিল। প্রযুক্তির কারণে রান্নার অনেক উপকরণ পাউডারে পরিণত হয়ে আসলেও এবার নতুনমাত্রায় যোগ হয়েছে পেঁয়াজের পাউডার (গুড়া)। পেঁয়াজের অগ্নিমূল্যের বাজারে শুনতে অবাক লাগলেও কাঁচা পেয়াজের চেয়ে গুড়াই রান্নার কাজে সুখের বার্তা যোগাবে। এ ছাড়া পেঁয়াজের গুড়া সংরক্ষণও করা যাবে দীর্ঘদিন। এতে দেশে পেঁয়াজ আমদানির ওপর চাপ কমমে সেই সাথে অর্থনীতির নতুন দ্বার উম্মোচন হবে। তাই এবার বগুড়ার শিবগঞ্জে অবস্থিত মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণায় নতুন উদ্ভাবিত কাঁচা পেঁয়াজ শুকিয়ে পাউডার তৈরী করায় রান্নার কাজে নতুন মাত্রা যোগ হলো।

মসলা গবেষণা কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে বছরে মোট পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন ২৩ দশমিক ৭৬ লাখ মেট্রিক টন। আর বাকি ১১ লাখ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয়। পেয়াজের অনেকাংশই পচনশীল হয়ে পড়ে, তবে সেই দিক চিন্তা করে পেয়াজের পাউডার করার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে বগুড়ার শিবগঞ্জে অবস্থিত মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. মো. মাসুদ আলম এ নতুন আবিস্কারে এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত গবেষণা করতে গিয়ে পেঁয়াজের পাউডার উদ্ভাবন করেন।

২০০৯ সালের দিকে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাসুদ পেঁয়াজের পাউডার প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ৫ বছর গবেষণায় বর্তমানে সফলতা পেয়েছে। বর্তমানে ওই গবেষকের উদ্ভাবণকৃত পদ্ধতিতে পেঁয়াজের পাউডার বানিজ্যিকভাবে বাজারজাত শুরু হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ওই কৃষি গবেষক ড. মাসুদ জানান, মাঠ থেকে সংগৃহীত হয়ে খাদ্যে ব্যবহার করার আগে পেঁয়াজের প্রায় ৩০ শতাংশই পচে যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের েেত্র এই সংরণ তির হার আরও বেশি; প্রায় ৭০-৮০ শতাংশিই পচনের কবলে পড়ে।

কৃষি গবেষকদের তথ্যমতে, ৪-৬ জনের একটি পরিবারে মাসে গড়ে ৫ কেজি পেঁয়াজ লাগে। এ হিসাবে একটি পরিবারে বছরে পেঁয়াজের মোট চাহিদা গড়ে ৬০ কেজি। তবে ৬০ কেজি পেঁয়াজ কোনো পরিবারের চাহিদা থাকলে বাজার থেকে কিনতে হয় ৮০ কেজির মতো। কারণ পেঁয়াজ কিনে রাখলে পচে যায়। কিন্তু পেঁয়াজ পাউডার করে রাখলে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। গুড়া করে ভালভাবে সংরণ করলে তা থাকবে প্রায় দু বছর। ড. মাসুদ জানান, পেঁয়াজ প্রক্রিয়াজাতকরণে গুড়া করলে এর গুণগত মান, খাদ্যে ব্যবহারের পরিমাণ কোনোটাই কমে না। এক কেজি পেঁয়াজ শুকিয়ে পাউডার পাওয়া যায় ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম। পাউডার প্রক্রিয়াজাতকরণ করে দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পেঁয়াজের পচন রোধ করাও সম্ভব। তাছাড়া পেঁয়াজ পচনশীল হওয়ার কারণে বেশি দিন সংরণ করা যায় না। তবে পেঁয়াজের পাউডার দুই বছর পর্যন্ত সংরণ করা যাবে। এর প্রক্রিয়াজাতকরণও খুব সাধারণ। যেকেউ ঘরেই বসেই পেঁয়াজের পাউডার তৈরি করতে পারবেন, তবে পেঁয়াজের পাউডার এখন বাজারজাত করার পর্যায়ে রয়েছে বলে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের এই গবেষক ড. মাসুদ জানান।
মসলা গবেষক ড. মাসুদ আরও বলেন, একটি পরিবারে এক কেজি মাংস রান্না করতে সাধারণত কাঁচা পেঁয়াজ লাগে ২৫০ গ্রাম। আর এই ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ পাউডার করলে পাওয়া যাবে ২৫ গ্রাম। মাংস রান্নাতে ওই ২৫ গ্রাম পাউডার দিলেই হবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কাঁচা পেঁয়াজের চেয়ে রান্নায় পাউডারে খরচও বেশি নয়।

বিশে^র উন্নতশীল দেশ জাপান, চীন, থাইল্যান্ড সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এ ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য বা মসলার ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পণ্য তৈরিতে এসব পাউডার ব্যবহার করা হয়। এ হিসেবে উদ্যোক্তারা দেশে পেঁয়াজের পাউডারের বাজার তৈরি করলে ব্যাপক আয়ের সম্ভবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাণ কোম্পানির প্রতিনিধি, সিলেটসহ দেশের অনেক জেলা থেকে একাধিক ব্যক্তি বগুড়ায় এসে ড. মাসুদের এই উদ্ভাবন দেখে গেছেন। ইতোমধ্যে সিলেটের দুজন ব্যক্তি পেঁয়াজের পাউডার প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু করেছেন বলে এই মসলা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুত্রে জানা গেছে।

তবে পেঁয়াজ পাউডার পদ্ধতিকে পুরোপুরি সমর্থন করে গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামীম রেজা বলেন, দেশে সব ধরনের মসলাই আমদানি নির্ভর। এজন্য আমরা যত এর চাষ ও বাজারজাতকরণ বৃদ্ধি করতে পারব; ততই লাভ। ড. মাসুদের তৈরি পেঁয়াজের গুড়া পদ্ধতি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি বানিজ্যিকভাবে যদি নাও কার যায় ঘরোয়াভাবে করলেও লাভ। এতেও দেশে পেঁয়াজের আমদানির দৌড়াত্ম কমবে।

পেঁয়াজের গুড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে একই গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ড. হামীম রেজা বলেন, পেঁয়াজের গুড়া বা পাউডার সূর্যের তাপে ও যান্ত্রিক পদ্ধতি দুভাবেই করা যায়। দুটোতেই খরচ খুবই সীমিত। এই প্রক্রিয়াজাত কাজে প্রয়োজন পেঁয়াজ কাটার যন্ত্র (স্লাইসার), প্লাস্টিকের পাত্র, লবণ, সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইড, ড্রায়ার মেশিন (শুকানোর যন্ত্র), পলি ব্যাগ। কয়েকটি ধাপে কাজগুলো শেষ হয়। প্রথমে পেঁয়াজ সংগ্রহ করে বাছাই করতে হয়। বাছাই করা পেঁয়াজ পরিস্কার করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। পরে সেগুলো স্লাইস করে কেটে নিয়ে ভাপ দিতে হয়। ভাপ দেয়া হলে পেঁয়াজগুলো সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইড দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপরের ধাপে পেঁয়াজ শুকাতে হয়। শুকিয়ে গেলে সেগুলো ব্লেডিং (গুড়া) করলেই কাজ শেষ। এ পাউডার যান্ত্রিকভাবে শুকিয়ে করলে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা। আর প্রাকৃতিকভাবে বাড়তি আর কয়েকদিন সময় লাগবে। এরপর গুড়া মোড়কে ভরে সংরণ করুন অথবা বাজারজাতকরণ করতে হবে।
তবে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা শুরু করতে হলে আমাদের সাথে সমঝোতা স্বাক্ষর চুক্তি (এমওইউ) করতে হবে। কারণ এই গবেষণা আমাদের তথা রাষ্ট্রের। এমওইউ থাকলে আমরাও বিভিন্ন সময়ে তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারব বলে উদ্ভাবনকারী এই গবেষক জানান।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title