করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে সেবাদানকারী “এক যোদ্ধার গল্প”

ফরিদপুর :: মনের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা ও ভয়ে বুকটা ধুকধুক করছিল। বারবার চোখের সামনে প্রবাসী স্বামীর ও তার আমানত হিসাবে আমার ছোট দুই শিশু কন্যা নুসরাত ও মারিয়ার চেহারা ভেসে আসছিল। যেখানে সারা বিশ্ব ধুকছে করোনা ভাইরাসে। আমি আমার দেশের আইসোলেশন ওয়ার্ডে মুমূর্ষু রোগীর সেবা করতে ঘর ছেড়ে পা বাড়িয়ে দিয়েছি। যদি আমিও আক্রান্ত হয়ে পড়ি! আমার কিছু হয়ে গেলে ওদের কী হবে? এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ডিউটি করা করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবাদানকারী একজন সাহসী যোদ্ধা ও মানবিক চেতনাধারী সেবিকা আফসানা আক্তার।

তিনি জানান, দিনটি ছিল ২১ এপ্রিল মঙ্গলবার। প্রথমদিন। সকালে যখন হাসপাতালের করোনা ডিউটিতে যাচ্ছিলাম। নিজের থেকে এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আইসোলশনে ডিউটি করার জন্য। কর্তব্য পালনে ব্রত নিয়ে নিজ থেকে করোনা ইউনিটের দায়িত্ব চেয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই।  বিশেষ ধরনের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পা থেকে মাথা পর্যন্ত) মাস্ক ও চোখে গ্লাভস পরার পর কোনোভাবেই শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিলাম না প্রথমদিকে। তারপর পিপিই ও মাস্ক পরে করোনা ডিউটি করতে আইসোলশনে প্রবেশ করি। অতপর এভাবে রোগিদের সেবা করতে গিয়ে দিনকে দিন একইচিত্র দেখতে দেখতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে যাই নিজের সম্মানিত পেশায়।

শুক্রবার (১লা মে)। এভাবেই ওই সাহসী নার্স আজ সকালে সাহসী সেবিকা আফসানা আক্তার করোনা রোগীদের সেবা নিয়ে বিশদ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন প্রতিবেদকের কাছে।

তিনি বলেন, আইসোলশনে ডিউটি করার সময় খুব কাছে থেকে করোনা রোগীদের শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে ছটফট করতে দেখেছি। ১০দিন ডিউটি শেষ করে হোম কোয়ারেন্টাইনে এসেছি। জানি না আমি নিজেই করোনা আক্রান্ত কি-না। কিন্ত দিন গুনছি কবে শেষ হচ্ছে ১৪ দিন? কারন হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে পরিবারের প্রিয়জনদের কাছে যেতে পারব। এরপরে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে পরিবারের কাছে থাকবো। ছুটি কাটিয়ে আবার করোনা রোগিদের সেবা করার জন্য ফিরে আসতে চাই। 

আমি এবং আমার সকল সহকর্মীদের চাওয়া করোনা আক্রান্তদের পাশে থেকে কাজ করতে হবে। সেই প্রত্যয়ে সেবা করতে গিয়ে অসুস্থ্য মানুষের জীবন যন্ত্রণার (রোগীদের) চিত্র দেখে দেখে নিজেদের কথা, অনুভূতি আমরা ভুলে গিয়েছি। কারন সেবার মাধ্যেমে রোগীদের সুস্থ্য করে তোলার কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছি। তিনি বলেন, করোনা আক্রান্তদের সেবার করতে নিজের থেকে চেয়ে নিয়ে দায়িত্ব পালন করছি। আমার সাথে (তার সাথে) ডিউটি করছেন আরো ৫জন সহকর্মী। দেশের মানুষের বিপদকালিন সময়ে আমার সহকর্মীদের সাথে নিয়ে করোনা যুদ্ধ  রুখতে আমরা সবাই দৃঢ় সংকল্প।

কাজের ক্ষেত্রে সাহসী সেবিকা আফসানা আক্তার বিশেষ করে তার সাথে দায়িত্ব পালন করা সেবিকা কাকলি খাতুন, ফারজানা, লাভলি, রেহেনা ও  মিনারা ওদের ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ওদেরকে কাছে পেয়ে কাজ করতে আমি এবং আমাদের সকলের অনেক সহজ হয়েছে।

তবে তিনি দুঃখের সাথে একটি ক্ষোভের কথা জানান। বিশেষ করে তাদের জন্য দেয়া বরাদ্দকৃত খাবারের মান? দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিদিন একই ধরনের খাবার দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রতিদিন আমাদের জন্য পাচঁশত টাকা খাবারের জন্য বরাদ্দ থাকলেও দেয়া হচ্ছে কম ও নিন্ম মানের খাবার। এই ব্যাপারটি উন্নত হওয়া খুবই দরকার বলে তিনি মনে করেন। কারন তানা হলে আমাদের (সেবিকাদের) শরীরের সমস্যা তৈরি হতে পারে। অন্যসকল বিভাগের খাবার মান থেকে করোনা যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সকলের খাবার মান উন্নত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে বলে তিনি জানান।  কিন্তু সকালে আমাদের জন্য কোন নাস্তার ব্যবস্থা না থাকায় কোন মতে সকালে নিজেদের মুড়ি চিড়া খেয়ে দুপুর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথাও তিনি জানান।

তিনি বলেন, গত ১০ দিনে তিনি আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাচঁজন করোনা রোগীকে খুব কাছে থেকে (ক্লোজ কন্টাক্ট) চিকিৎসা দিয়েছেন। এরমধ্যে পাচঁজনের রোগীর তিনজন তাদের সেবাকালিন সময়ে সুস্থ্য করে বাড়িতে যেতে সাহায্য করেছেন। তিনি জানান, তাদের আইসোলশনে থাকার সময়ে গত কদিন আগে দুজন রোগি করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়ে মৃত্যু বরন করেন। কিন্ত চিকিৎসক ও সেবিকারা প্রথম থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলাম তারা কেউ করোনা রোগি নই। তারপরও তাদের চিকিৎসা করানো হয়। এ সময় কর্তব্যরত নার্সরা সার্বক্ষণিক পাশে ছিলেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও তাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। কিন্ত তারপরও তাদের বাচাঁনো যায়নি।

প্রসঙ্গত গত ১০ দিন একটানা ডিউটি শেষ করে সেবিকা আফসানা আক্তার এখন ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন হাসপাতালের কোর্য়াটারে। কোয়ারেন্টাইন শেষ না হলে তিনি পরিবারের কাছে যেতে পারছেন না। হাসপাতালে বসে প্রবাসী স্বামী ও কন্যাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে কাটছে তার দিনগুলো। পাচঁ বছরের ছোট্র মেয়েটি যখন মা বলে ডেকে ওঠে তখন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু এ মুহূর্তে কাছে গেলেই সংক্রমিত হতে পারে-এ আশঙ্কায় বুকে পাথর বেঁধে অপেক্ষা করছেন। দুই কন্যাকে ফেলে ডিউটি করার জন্য তার মোটেও খারাপ লাগেনি। বরং পেশাদার নার্স হিসেবে মুমূর্ষু রোগীর সেবা করতে পেরে নিজেকে গর্বিত বলে মনে করেন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা সাহসী যোদ্ধা ও মানবিক চেতনাধারী সেবিকা আফসানা আক্তার।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title