মোদি-অমিত বাহিনীদের রুখে দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: মোদি-অমিত বাহিনীদের রুখে দিয়ে পশ্চিম বাংলার মসনদ অক্ষত রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জোড়াফুল ছাপিয়ে গেল পদ্মফুলকে। ২৯২টি আসনের নির্বাচনে ২১৬টি আসন পেয়ে ফের নবান্নে বসতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রস। বিজেপির প্রাপ্ত আসন হচ্ছে ৭৫টি। অন্যান্য দল পাচ্ছে মাত্র ২টি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, কংগ্রেস নেতা অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
নন্দীগ্রামে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৩ ভোটে হেরে গেলেও তার ম্যাজিকে গেরুয়া ঝড় রুখে দিয়ে তৃতীয় তথা হ্যাটট্রিক জয় এনে দিয়েছেন নিজ দলকে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তার দল ২১১টি আসন পেয়েছিল। ৭৭টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাম-কংগ্রেস জোট এবং ৩টি আসন পেয়েছিল বিজেপি।
এদিকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের আন্না ডিএমকে-কে পরাজিত করে তামিলনাড়–র ক্ষমতায় বসতে চলেছেন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের ডিএমকে বা দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম। ২৩৪ আসনের বিধান সভায় ডিএমকে পেতে চলেছে ১৫৬টি আসন। অন্যদিকে আন্না ডিএমকে পেতে যাচ্ছে ৭৮টি আসন।
আসাম বিধান সভার নির্বাচনে পূর্বাভাস মতো বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখছে। ১২৬ আসনের বিধান সভায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ ৭৫টি আসন পেতে যাচ্ছে, অন্যদিকে ৫০টি পাচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট।
কেরালায় লাল পতাকা তথা বাম ফ্রন্ট ৯৯ আসন পেতে যাচ্ছে ১৪০ আসনের বিধান সভায়। অন্যদিকে ইউডিএফ পেতে যাচ্ছে ৪১ আসন। এ রাজ্যে বিজেপি কোন আসন পাচ্ছে না।
এদিন আরো ঘোষিত হল পুদুচেরি বিধান সভা আসনের ফলাফল। এ রাজ্যে ৩০ আসনের পার্লামেন্টে ২৫ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সরকার গঠনের জন্য ১৬ আসনের প্রয়োজন হলেও বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ১৪টি আসন পেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ৬টি আসন পেয়ে রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। অন্যরা পেয়েছে ৫টি আসন।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতেছিলেন এমন হেভিওয়েট প্রার্থী এ দফা হেরে গেছেন। এর মধ্যে নন্দীগ্রাম নিয়ে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ১৭ রাউন্ড ভোটগণনার পর তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সেখানে জয়ী হয়েছেন বলে খবর আসছিল, কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতে মমতার জয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বলা হয়, সার্ভারে সমস্যার জেরে সঠিক ভাবে কিছু জানা যাচ্ছে না। তার পরেই ১৬২২ ভোটে শুভেন্দু অধিকারীর জয়ের খবর আসে। এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে আনন্দবাজার ডিজিটালকে ফোনে তিনি বলেন, ‘১৬২২ ভোটে জিতেছি আমি।’ যদিও পোস্টাল ব্যালট ছাড়া মমতার সাথে শুভেন্দুর জয়ের ব্যবধান ৯৭৮৭ ভোটের। তার পর সংবাদ সম্মেলনে নন্দীগ্রামে হেরে গিয়েছেন বলে জানান মমতা। তিনি বলেন, ‘নন্দীগ্রাম যা রায় দেবে, মাথা পেতে নেব।’
তবে নিজে হারলেও দলের জয়ের জন্য বাংলার মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘বাংলার জয়ের জন্য সকলকে অভিনন্দন। বাংলার জয়, মানুষের জয়। বাংলা আজ ভারতকে বাঁচিয়েছে।’
নন্দীগ্রামের মানুষ যা করেছেন, ভালো করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। একইসাথে ফলাফল নিয়ে এই বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন মমতা। তার অভিযোগ, ‘আমার কাছে অভিযোগ রয়েছে, রায় ঘোষণার পর কারচুপি হয়েছে।’
এর আগে যদিও সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছিল, ১২০২ ভোটে নন্দীগ্রামে জয়ী হয়েছেন মমতা। সার্ভারের ত্রুটির জেরে দুপুরে এমনিতেই ৪০ মিনিট ভোটগণনা বন্ধ ছিল সেখানে। তার পর মমতার জয়ের খবর সামনে আসার পরও কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি কমিশন। তারপরেই জানা যায়, শুভেন্দু জয়ী হয়েছেন। তবে কমিশনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে, একুশের বাংলায় হ্যাটট্রিক করার পর কেন্দ্র সরকারকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সকল দেশবাসীকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছি কেন্দ্র সরকারের কাছে, তা না দিলে গান্ধী মূর্তির সামনে অহিংস আন্দোলন করব’, জয়ের পর এ ভাষাতেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন মমতা আরো বলেন, ‘এতটা পাব ভাবতেও পারিনি। খুব খুশি আমি। যারা আমায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ। বিজেপি-কে নিশানা করে মমতা বলেন, ‘ বিজেপি-র ধস নেমেছে, এই ধস যেন বজায় থাকে। বিজেপি গো-হারা হেরে গিয়েছে।’
দলের জয়ের পর এদিন সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, ‘আমার একটা টার্গেট করা ছিল ২২১। আমি বলেছিলাম ডাবল সেঞ্চুরি করব। বাংলার জয় হয়েছে। বাংলার মা-বোনেদের জয় হয়েছে। স¤প্রীতি, সংহতির জয় হয়েছে। সারা ভারতবর্ষকে বাঁচিয়েছে’। তৃণমূলনেত্রী আরো বলেছেন, ‘সত্যিই খেলা হয়েছে, আমরা জিতেছি। কোভিড কমে গেলে ব্রিগেডে বড় করে বিজয় মিছিল হবে। মমতা বলেছেন, ‘কোভিড পরিস্থিতিতে এখনই লকডাউন নিয়ে কথা বলব না’।
প্রসঙ্গত, উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ১৮টি আসনে পদ্মফুল ফুটিয়ে অভ‚তপূর্ব উত্থান ঘটেছিল বিজেপি’র। সেই সাফল্যের ধারা বজায় রেখে একুশের মহাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গেরুয়া শিবির। এদিকে, সর্বশক্তি দিয়ে বিজেপি-কে রুখতে উঠেপড়ে লেগেছিল জোড়াফুল শিবির। একুশের লড়াইয়ে বাংলাকে পাখির চোখ করেন মোদি-শাহরা। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, বিজেপি-কে রুখে ফের বাংলার কুর্সি দখল করতে পারায় জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপিবিরোধী জোটের প্রধান মুখ হয়ে উঠবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নির্বাচনে দলের জয়লাভে অভিনন্দনে সিক্ত হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে জয়ের জন্য মমতা দিদি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ও করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেন্দ্র রাজ্য সরকারকে সবরকম সাহায্য করা জারি রাখবে। এই ভাষাতেই তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়ে ট্যুইট করেন নরেন্দ্র মোদি।
তিনি আরো একটি ট্যুইট করে লেখেন, ‘কার্যত নগণ্য উপস্থিতির একটি দলকে উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিতি জানান দিতে সাহায্য করার জন্য বাংলার সমস্ত ভাই-বোনদের ধন্যবাদ জানাতে চাইব। বিজেপি মানুষের হয়ে কাজ করা জারি রাখবে। দলের সমস্ত কার্যকর্তা যেভাবে লড়াই করেছেন, তাদের সকলকে অভিনন্দন জানাতে চাইব’।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, যা ট্রেন্ড তাতে মানুষ মমতাজিকেফের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। সন্ধ্যে পর্যন্ত দেখব। ফল যা আশা করেছিলাম তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তার পরেও বলব আমরা অনেকটা উন্নতি করেছি। গত বিধানসভা আমাদের ৩টি আসন ছিল। সেই ৩ থেকে আমরা কতটা আসন বাড়াতে পারব তা সন্ধ্যে পর্যন্ত বোঝা যাবে।
নিজের আসনে হেরে গেছেন আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। তবে তিনিও তৃণমূলের এই ফলকে একপ্রকার মেনেই নিলেন। বাবুল সুপ্রিয় বলেন, মানুষ এটাই চাইছে।
মোদি-শাহদের পরাস্ত করে মমতার এ হেন জয় নিয়ে উচ্ছ¡সিত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছেলে তথা কংগ্রেস নেতা অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। টুইটারে মমতার দরাজ প্রশংসা করে প্রণব-পুত্র লিখেছেন, ‘দিদি, একা হাতেই বাংলায় গেরুয়াবাহিনীকে রুখেছেন। স্যালুট জানাচ্ছি’।
এতেই শেষ নয়, প্রণব-পুত্র আরো লিখেছেন, মেরুকরণের চেষ্টা, কোটি কোটি টাকা ছড়িয়েও, পর্যটকদল, ভুয়ো খবর, ঘৃণ্য প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতি বিজেপি-কে সাহায্য করল না। উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনে বাংলায় পদ্মফুল ফোটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল গেরুয়া বাহিনী। কিন্তু, শেষমেশ মমংতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশ্মায় ধরাশায়ী হয়েছে তারা। অন্যদিকে, একুশের নির্বাচনে খাতা খুলতেই পারেনি কংগ্রেস। নিজের দলের ধাক্কার থেকে তৃণমূলের কাছে বিজেপির পরাজয় নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হলেন প্রণব-পুত্র, তা রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, জি নিউজ, নিউজ১৮ ও এবিপি আনন্দ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title