আসছে কঠোর লকডাউন

নিউজ প্রতিবেদক: করোনাভাইরাস পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও অনেক রোগী শয্যা পাচ্ছেন না। সাধারণ শয্যার পাশাপাশি আইসিইউ পেতেও হাহাকার চলছে। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউর একটি শয্যাও খালি নেই। রোগীর এমন চাপ অব্যাহত থাকলে হাসপাতালে জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। এখন ‘কঠোর লকডাউনের’ কথা ভাবছে সরকার। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ১৪ এপ্রিল থেকে এ পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর কভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি অন্তত দুই সপ্তাহ ‘পূর্ণ লকডাউনের’ সুপারিশ করেছে।

মন্ত্রী জানিয়েছেন, গত বছরের মতো জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ থাকবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না। এই লকডাউন কার্যকর করতে মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দুই সপ্তাহের লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এক সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত নয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্তত টানা ১৪ দিন লকডাউন হতে হবে। কারণ করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল ১৪ দিন। একজনের শরীরে এই ভাইরাস এক থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢিলেঢালা লকডাউনে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজারের ওপরে থাকছে। প্রতিদিন গড়ে ৬০ জনের ওপরে মৃত্যু হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আরও কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। কারণ করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অধিকাংশ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণও করেছেন অনেকে। এ অবস্থায় আক্রান্ত আরও বাড়তে থাকলে হাসপাতালে সেবা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় ঢিলেঢালা নয়, কঠোর লকডাউনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়। কিন্তু অর্থনীতি, জীবনযাত্রাসহ সার্বিক বিষয় আমলে নিয়ে সরকারের উচ্চমহল দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। তবে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশে নড়েচড়ে বসে সরকার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার রাতে ভার্চুয়াল পর্যালোচনা সভা করে কভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সভায় উপস্থিত একটি সূত্র সমকালকে জানায়, কমিটির সদস্যরা মনে করেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। কমিটির পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার সরকারের উচ্চমহলে পরিস্থিতি তুলে ধরে ‘কঠোর লকডাউনের’ সুপারিশ করা হয়।

এদিকে গতকাল জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে অন্তত দুই সপ্তাহ ‘পূর্ণ লকডাউনের’ কথা বলা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে পূর্ণ লকডাউনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অন্তত দুই সপ্তাহ ‘পূর্ণ লকডাউন’ ছাড়া করোনাভাইরাসের বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে এতে উল্লেখ করা হয়।

পরামর্শক কমিটি মনে করে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে ১৮টি নির্দেশনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হয়েছিল, সেগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। ওই বিধিনিষেধ আরও কঠোরভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন।

হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, করোনার সংক্রমণ বাড়ায় হাসপাতালে রোগী ভর্তির চাপও বাড়ছে। তাই দ্রুত হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।

করোনা পরীক্ষা সম্প্রসারণের পরামর্শ দিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করতে আসা ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ বিদেশগামী। অভিবাসী কর্মজীবী মানুষ ছাড়া অন্যদের পরীক্ষার জন্য বেসরকারি পরীক্ষাগারে পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। এতে রোগীদের পরীক্ষা ও রিপোর্ট দ্রুত প্রদান করে আইসোলেসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিষয়টি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাজ্যে টিকাদান কার্যক্রম ভালো ফল এনেছে উল্লেখ করে কমিটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশেও টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে এবং টিকা সরবরাহ নিশ্চিতে বেসরকারিভাবে আমদানির ওপর জোর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এদিকে নিজ বাসভবন থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা। এ অবস্থায় সরকার জনস্বার্থে ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের বিষয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে।

আর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য ‘কঠোর লকডাউনে’ যাচ্ছে সরকার। এই সময়ে জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। সংক্রমণ রোধে সবাইকে লকডাউনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, চলমান বিধিনিষেধে কিছু কিছু বিষয়ে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু নতুন যে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের নমনীয়তা দেখানো হবে না। জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

দেশে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ৫ এপ্রিল থেকে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তা প্রথম দিন থেকেই ঢিলেঢালা ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা ওই ব্যবস্থাকে ‘বিধিনিষেধ’ বলা হলেও সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী একে ‘লকডাউন’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই কোথাও লকডাউনের লেশমাত্র ছিল না। গত বুধবার গণপরিবহন চালু করা হয়। আর পরদিন অপর এক নির্দেশনায় দোকান ও শপিংমল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এভাবেই ওই বিধিনিষেধ অকার্যকর হয়ে পড়ে।

কঠোর হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মানুষকে যেভাবেই হোক ঘরে রাখতে হবে। অন্যথায় সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। হাসপাতালে আক্রান্তদের ঠাঁই মিলবে না। এই পদক্ষেপ কার্যকর করতে সরকারকেও আরও বেশি ‘কঠোর’ হতে হবে। মানুষকে বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করতে হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, সেটি বাস্তবসম্মত ছিল না। কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে কিছু বন্ধ রেখে লকডাউন হয় না। শিল্পকারখানা খোলা কিন্তু দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ। আবার অফিস-আদালত খোলা, আর পরিবহন বন্ধ- এভাবে হয় না। এ ধরনের পদক্ষেপে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। বন্ধ করলে সবকিছুই করতে হবে। যে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে, আশা করি সরকার এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সূত্র: সমকাল

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title