হঠাৎ ককটেল বিস্ফোরণ বাসে আগুন কীসের আলামত?
- আপডেট সময় : ১১:৫৫:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫
- / 8
গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগেই না কি একই দিনে হবে, তা নিয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন। নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে এরইমধ্যে রাজপথে নেমে পড়েছে জামায়াত নেতৃত্বাধীন আট রাজনৈতিক দল। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায় ঘোষণার দিন ধার্য নিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ১৩ নভেম্বর ঢাকায় লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়েছে।
গত কয়েকদিনে রাজপথে চলেছে নানা ধরনের অপতৎপরতা। বাসে আগুনসহ রাজধানী জুড়ে বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, গণভোট নিয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব যখন প্রকাশ্যে, তখনই আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচি এবং রাজপথে এসব অপতৎপরতা কীসের আলামত? জাতীয় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হচ্ছে কি না? যদি সেটাই সত্যি হয়, এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে কারা?
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচি ঘিরে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আতঙ্ক ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরোনো কিছু ভিডিও ছড়িয়ে দাবি করা হচ্ছে, এসব ভিডিও লকডাউন কর্মসূচি সফল করতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী সমর্থকদের অংশগ্রহণের। যদিও ফ্যাক্টচেকে তা পুরোনো বলে জানা যায়।
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একের পর এক বাসে অগ্নিসংযোগ, বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জনমনে। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন করা হবে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি কঠোরভাবে দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এটা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর নয়, এটা জুলাই, চিরকালের জন্য।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ১ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। গত দুই দিনে ৯টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং গত ২৪ ঘণ্টায় এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সোমবার দিবাগত রাজধানীতে তিনটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওইদিন রাত ১টার দিকে রায়েরবাগে, ২টার দিকে যাত্রাবাড়ী এবং সবশেষ ভোর ৪টায় সোনারগাঁও জনপদের খালপাড় এলাকায় বাস তিনটিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে পোড়া তিনটি বাসই সড়কের পাশে পার্কিং করা ছিল। তবে অগ্নিকাণ্ডে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলেও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
এর আগে রাত ১১টার দিকে বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পালিয়ে যাওয়ার সময় দুজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন এনসিপি নেতাকর্মীরা। গণপিটুনি দিয়ে পরে তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। ককটেল বিস্ফোরণে এনসিপির এক সদস্যসহ তিনজন আহত হন।
সোমবার ভোর ৪টায় মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সামনে ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যান দুজন ব্যক্তি। সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে এই ঘটনা। এতে হতাহত হননি কেউ।

আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হেলমেট পরা দুই মোটরসাইকেল আরোহী একই কায়দায় মোহাম্মদপুর স্যার সৈয়দ রোডে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান।
এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ধানমন্ডিতে ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট।
এর আগে ভোর ৫টায় গুলশানের শাহজাদপুর বাঁশতলায় ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে ও সকাল সাড়ে ৬টায় মেরুল বাড্ডায় আকাশ পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
এরপর গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর সূত্রাপুরে মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের এক ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তার আগে সকাল পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় ইস্পাহানী বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের গেটের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যদিও এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
মঙ্গলবার রাতে গাজীপুরে তিন যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। জেলার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাসন, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের শ্রীপুর ও চন্দ্রা-নবীনগর সড়কের চক্রবর্তীর এলাকায় থেমে থাকা তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।

চলমান দুর্বৃত্তায়ন ও অপতৎপরতায় এখন পর্যন্ত বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুর্বৃত্তরা যেভাবে নাশকতা চালাচ্ছে, তাতে রাস্তায় চলাচল করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
মতিঝিলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের নারী কর্মকর্তা নাজনীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আগে অফিসের গাড়িতে শ্যামলী থেকে অফিস যেতাম। এখন মেট্রোরেলে যাতায়াত করি। কিন্তু ইদানিং আতঙ্কিত বোধ করছি। কখন কোন সময় ককটেল এসে শরীরে লাগে ভয় লাগে, বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে।
মিরপুর ৬০ ফিট এলাকার বিএনপির এক কর্মী বলছেন, প্রতিশোধ নিতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেরকমটা হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটা নিয়ে জনমনে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। তবে আমরা নাশকতাকারীদের হাতেনাতে ধরার চেষ্টায় মাঠে আছি।
বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণের মতো অপতৎপরতা চালাচ্ছে কারা? জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেননি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অপচেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪টি ঝটিকা মিছিল করেছে তারা। স্বল্প স্থায়ী এসব ঝটিকা মিছিলের ছবি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ঝটিকা মিছিল পরিচালনা, অর্থায়ন ও অংশগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও অঙ্গ সংগঠনের ৫৫২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, গ্রেপ্তাররাসহ জড়িতদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। অর্থের বিনিময়ে তারা ঢাকায় এসে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণ করে আবার ঢাকার বাইরে চলে যায়।

নগরবাসীকে অনুরোধ জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত আলী বলেন, অপরিচিত কোনো লোককে আপনারা আশ্রয় দেবেন না। মেস, হোটেল ও গেস্ট হাউজে পরিচয়পত্র দেখে বোর্ডার উঠানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি। এ ছাড়া নিজের নামে মোটরসাইকেল বা যানবাহন অন্য কাজে ব্যবহারের পূর্বে অথবা ভাড়া প্রদানের পূর্বে কোনো দুর্বৃত্তের হাতে চলে যাচ্ছে কি না দৃষ্টি রাখবেন। আপনার এলাকায় আগন্তুক কাউকে দেখলে বা সন্দেহভাজন ঘোরাফেরা করতে দেখলে তা দ্রুত নিকটস্থ থানায় অথবা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ অবহিত করবেন।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঢাকায় লকডাউন কর্মসূচি সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমাদের পাঁচ দফায় মানবতাবিরোধী অপরাধী খুনিদের যে বিচারের দাবি করেছি ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যখন এই নভেম্বরে কিছু অপরাধীর রায়ের সম্ভাবনা, তখন ফ্যাসিস্টরা বাংলাদেশজুড়ে ককটেল, গাড়িতে আগুন দিয়ে নাশকতার ষড়যন্ত্র করছে।
সরকার ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আমরা শুনছি, ঢাকার হোটেলে হোটেলে সন্ত্রাসীরা অবস্থান নিয়েছে। আপনারা অভিযান চালিয়ে ফ্যাসিস্টদের গ্রেপ্তার করুন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ১৩ নভেম্বর ঘিরে শক্ত অবস্থানের জন্য আমাদের প্যাট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে। কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া যেখানে-সেখানে খোলা তেল বিক্রি বন্ধসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। আগামী ১৩ তারিখ ঘিরে আমাদের কার্যক্রম চলছে। সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই আমাদের পুলিশকে সবাই সেটা জানান।
তিনি বলেন, সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবেন। আগামী ১৩ নভেম্বর ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তারা যেহেতু শক্ত অবস্থানে থাকবে সেহেতু পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। কোনো ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই।
উপদেষ্টা বলেন, বাসে আগুন এবং কয়েক জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে, এটা সত্য কথা। এগুলো যেন আর না করতে পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা এগুলো করছে তারা দুষ্কৃতকারী। এদের প্রতিহত করার দায়িত্ব শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নয়, বরং রাজনৈতিক দল, সচেতন জনগণ এবং আপনাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এ বিষয়ে আপনারা এগিয়ে আসবেন, আমার অনুরোধ।
ককটেল-বাসে আগুন কিসের আলামত? নির্বাচন বানচালের চেষ্টা কি না? জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক আইজিপি নুltw1রুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হতে পারে। যারা চায় নির্বাচন ভন্ডুল বা বানচাল হোক, তারা এ ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাতে পারে।
তবে তিনি বলেন, ভায়োলেন্স হলেই যে নির্বাচন ভণ্ডুল হয় বা নির্বাচন বানচাল হতে পারে না তা কিন্তু না। অতীতে ভায়োলেন্সের মধ্যে নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে। তবে যাদের ইচ্ছে ভায়োলেন্স করার তারা করছে, একটা দল বা গ্রুপই করছে।

তিনি বলেন, সরকার কমিটেড। যথা সময়ে নির্বাচনের ব্যাপারে। সুতরাং সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমার পরামর্শ- প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন যথাসময়েই হবে আত্মবিশ্বাস রেখেই সরকারকে ভায়োলেন্সবিরোধী ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ জনগণও নির্বাচন চায়। জনগণ ভায়োলেন্স দেখতে চায় না।


























